মুক্ত সংসোধনাগারে থেকেই রোজগার করছে সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা।
শংকর কুমার রায়, রায়গঞ্জ: কারাগারের অন্ধকার জীবন থেকে আজ ওরা আলোর পথযাত্রী। ভয়ংকর অপরাধ করে একদিন আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছিল। জেলের ভিতরে থাকতে থাকতে সেই সব কুখ্যাত অপরাধীরা ধীরে ধীরে নিজেদের বদলে ফেলে। অপরাধপ্রবণতা ভুলে ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে। যেসব কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীরা সুস্থ জীবনে ফেরার চেষ্টা করে, তাদেরই আলোর পথ দেখাচ্ছে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের মুক্ত সংশোধনাগার।জেল বলতে যেমন অন্ধকার কারাগারের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মুক্ত সংশোধনাগার কিন্তু তা নয়। তার থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। গাছাপালা, ঘরবাড়ি নিয়ে একটা ঘেরা জায়গা। অবশ্যই সংরক্ষিত। যেখানে সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা বন্দি থাকে না। ওই সংরক্ষিত এলাকায় ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারে। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে বাইরেও যেতে পারে। জেলের ভিতরে থাকা যেসব সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে সুস্থ জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে, তাদেরই ঠাঁই হয় এই মুক্ত সংশোধনাগারে। কারাগারের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে যেসব কুখ্যাত অপরাধীরা এখন মুক্ত সংশোধনাগারে রয়েছে, কেমন আছে তারা? চলুন একবার দেখা যাক।
দুলাল মোমিন: মালদহের কালিয়াচকের জুতোর দোকানি দুলাল মোমিন। ২০০৭-এ স্থানীয় যুবককে খুনের দায়ে তাকে যাবজ্জীবনের সাজা শোনায় আদালত। এরপর থেকেই তার ঠিকানা ছিল বহরমপুরের কেন্দ্রীয় কারাগার। টানা ১০ বছর সেখানে কাটানোর পর এখন তার নতুন ঠিকানা বহরমপুরের মুক্ত সংশোধনাগার। প্রায় স্বাধীন জীবন বলা চলে। প্রতিদিন ভোরে টোটো নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়ে মধ্যবয়সি দুলাল। সারাদিন রোজগারের পর ঠিক রাত আটটায় মুক্ত সংশোধনাগারে ফিরে আসে।
পাউলুস ওঁরাও: ১৯৯৩ সালে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে খুন করে জেলে যায় জলপাইগুড়ি চা বাগানের শ্রমিক পাউলুস ওঁরাও।পরবর্তীতে আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন সাজা পায় ওই শ্রমিক।আদালতের রায়ে প্রথম বহরমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ঠাঁই হয়। সেখানে ভাল কাজের জন্য প্রশংসিত হয় পাউলুস। জেলকর্তারা খুশি হয়ে তাকে লালগোলার মুক্ত সংশোধনাগারে পাঠিয়ে দেন। তারপর সেখান থেকে রায়গঞ্জের এই মুক্ত সংশোধনাগারে। দেখতে দেখতে এখানে ১৬ মাস কাটিয়ে দিয়েছে বছর বাষট্টির পাউলুস। এখন সবজি বিক্রি করেই রোজগারের রাস্তা খুঁজে নিয়েছে সে। প্রতিদিন সকাল ছটায় সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে সাইকেলে করে সবজি ফেরি শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে থাকার জন্য মাঝেমধ্যে বাড়ি যাওয়ারও সুয়োগ পায় সে। তবে সঠিক সময়ে সংশোধনাগারে ফিরে আসে।
আবদুল শেখ:২০০৫-এ প্রতিবেশী যুবককে খুন করে জেলে যায় কালিয়াচকের আবদুল শেখ। ১২ বছর কারাবাসের সাজা খেটে এখন রায়গঞ্জের মুক্ত সংশোধনাগারই হল তার ঠিকানা। কারাগারে থাকার সময় ভাল কাজের জন্যই এখানে আসার সুযোগ পেয়েছে আবদুল। এখন স্থানীয় কলেজ পাড়ায় চায়ের দোকানও চালায়। প্রতিদিন সকালে গিয়ে দোকান খোলে। সারাদিন বিক্রিবাট্টার পর আটটা বাজার কিছু আগেই সংশোধনাগারে ফিরে আসে। আবদুল শেখের কথায়, ‘কাজের খাতিরে সারাদিন বাইরে থাকার পর রাতে সংশোধনাগারে ফিরে আসি। ভাবছি একদিন এমন ভাল কাজ করব যাতে পাকাপাকিভাবে বাড়ি ফিরে যেতে পারি।’
কেউ খুনের আসামী, কেউ ধর্ষণ করে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছে। কারাগারের অন্ধকারে কাটিয়ে দিয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর। তারপর নতুন জীবনের আশায় চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতেই এই কুখ্যাত অপরাধীরা নিজেদের পালটাতে শুরু করে। জেলকর্তাদের তদারকিতে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের এই বদল নজরে আসে। তাই সাজার মেয়াদ ফুরনোর আগেই অনেকের ঠাঁই হয় মুক্ত সংশোধনাগারে। সেখানেই সংসার চালানোর জন্য সৎ পথে রোজগারও শুরু করে তারা। এভাবেই অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একসময়ের কুখ্যাত অপরাধীরা।
জানা গিয়েছে, রায়গঞ্জে মুক্ত সংশোধনাগার চালু হয় ২০১৬-র জানুয়ারিতে। প্রথমে ২০জন আসামীকে এখানে আনা হয়েছিল। যাদের প্রত্যেকেই আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছে। মুক্ত সংসোধনাগারে আসার পর তাদের রোজগারের বন্দোবস্ত করা হয়। সকাল ছ’টায় রুজিরুটির সন্ধানে বেরিয়ে গিয়ে ফের রাত আটটায় ফিরে আসতে হবে। তবে ১৭ জনের মধ্যে দু’জন নিয়মভঙ্গ করায় অন্ধকার কারাগারে ফিরে গিয়েছে।বাকি ১৫ জনের মধ্যে একজনকে আদালতের নির্দেশে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এখন ১৪জন আসামী রয়েছে এখানে। তারা প্রতিদিন নিয়ম করে কাজে বেরিয়ে যায়, রাত হলে ফের সংশোধনাগারে ফিরে আসে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.