দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: কবিগুরুর বিশাল জীবন নিয়ে কাহিনির অন্ত নেই। কত ছোট-বড় অজানা কাহিনি রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এবার রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore)১৬১ তম জন্মদিনের আগে প্রকাশ্যে এল তেমনই এক অজানা গল্প। রবীন্দ্রনাথের এক ‘নাতনি’ পারুল দেবীর কথা জানা গেল। সৌজন্যে চন্দননগর রাসবিহারী রিসার্চ ইন্সটিটিউট। এ কাহিনি প্রেক্ষাপট হুগলির চন্দননগর (Chandannagar)।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে নিয়ে নানা চর্চার মাঝে এখনও উপেক্ষিতা পারুল দেবী। চন্দননগরের গঙ্গাবক্ষে বজরায় বসে কবি তাঁর পরম স্নেহধন্যা নাতনি পারুল দেবীকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টান্বিতা কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু কে এই পারুল দেবী, তা আজও অনেকে জানেন না। কবির শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন পারুল দেবী। চন্দননগর রাসবিহারী রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কর্ণধার কল্যাণ চক্রবর্তীর কাছ থেকে জানা গেল সেই ইতিহাস। পারুল দেবী ছিলেন কলকাতার কালিদাস লাহিড়ী লেনের বাসিন্দা কলকাতা হাই কোর্টের দুঁদে আইনজীবী শরৎচন্দ্র লাহিড়ীর কন্যা। পারুল দেবীর ঠাকুরদা মহেন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন কবির বন্ধু। সেই সূত্রে লাহিড়ী বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল কবিগুরুর।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে পারুল দেবীর বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু স্বামীর আর্থিক পরিস্থিতি ভাল ছিল না। তাই বিয়ের পরও তিনি বাপের বাড়িতেই থেকে যান। কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন পারুল দেবী। প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আর সেই সময় নাতনির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কবি। কবির অপত্য স্নেহ ও ভালোবাসার স্পর্শে পারুল দেবী ফের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পান। সুস্থ হওয়ার পর পারুল দেবী নতুন নতুন খাবার তৈরি করে খাওয়াতেন প্রিয় দাদু রবীন্দ্রনাথকে। ভোজন রসিক রবীন্দ্রনাথ পারুল দেবীর হাতের রান্না খেতে ভালবাসতেন।
একটা সময় কবি পাকাপাকিভাবে শান্তিনিকেতনে (Santiniketan) থাকতে শুরু করেন। তবে তারপরও বেশ অনেকবারই তিনি চন্দননগরে এসে কখনও পাতাল বাড়ি, কখনও রিভার ভিউ, আবার কখনও বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে সময় কাটিয়ে গিয়েছেন। ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ চন্দননগরে থাকাকালীন রয়েছেন। সেই সময় পারুল দেবী তাঁকে এক হাঁড়ি মিষ্টি পাঠিয়ে ছিলেন। এই মিষ্টান্ন পাওয়ার পরই কবি চন্দননগরে গঙ্গাবক্ষে বজরায় বসে নাতনিকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টান্বিতা কবিতা লেখেন –
“যে মিষ্টান্ন সাজিয়ে দিলে হাঁড়ির মধ্যে
শুধু কি তাই ছিল কেবল শিষ্টতা
যত্ন করে নিলেম তুলে গাড়ির মধ্যে
দূরের থেকেই বুঝেছি তার মিষ্টতা।”
‘প্রহাসিনী’ কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাটি ছাপা হয়েছে পরবর্তীতে। পারুল দেবী আবদার করে কবির কাছে তাঁর পায়ের মাপ চেয়েছিলেন। নাতনির আবদার ফেলতে পারেননি কবিগুরু। নাতনিকে তাঁর পায়ের মাপ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরে নাতনি নিজের হাতে কাপড়ের উপর এমব্রয়ডারির কাজ করে এক জোড়া জুতো তৈরি করে কবিকে পাঠিয়েছিলেন।
এই জুতো জোড়া উপহার পাওয়ার পর কবি রীতিমতো আপ্লুত হয়ে নাতনিকে চিঠি লিখেছিলেন যে তার সুরচিত অর্ঘ্য তাঁর পায়ের কাছে এসে পৌঁছেছে। পরে তাঁর ব্যবহৃত এক জোড়া চটি, দোয়াত, কলম ও একগুচ্ছ মাথার চুল পাঠিয়ে পারুল দেবীকে বলেছিলেন, তিনি যখন এই পৃথিবীতে থাকবেন না তখন এই চুল দেখে নাতনি যেন তাঁকে স্মরণ করে। এরকম দাদু-নাতনিকে নিয়ে অসংখ্য ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে। বহু ইতিহাসের সাক্ষী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চটি জোড়া, মাথার একগুচ্ছ চুল, দোয়াত কলম, যে থালাতে তিনি খেতেন সেই থালা, বসবার চেয়ার আজও চন্দননগর রাসবিহারী রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সযত্নে রাখা আছে, যা দেখে কবির জীবনের অনেক তথ্য জানা যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.