সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: নাতি অসুস্থ সঙ্গে জ্বর, খিঁচুনি। নড়ছে না হাত-পা। কথা বলতেও সমস্যা হচ্ছে। তাই গুণিনের নিদানে ঠাকুমাকে ‘ডাইনি’ সাব্যস্ত করল তার ছেলে-বউমারা। নাতির প্রতি নজর দিয়ে কেন ‘ডাইনি বিদ্যা’ কার্যকর করা হয়েছে? এই অভিযোগ তুলে ঠাকুমাকে মারধর তাঁর দুই ছেলে এবং তাঁদের স্ত্রীরা। পুরুলিয়ার (Purulia) এই ঘটনায় ওই বৃদ্ধা এখন ঘরছাড়া। তিনি তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ।
এমন কুসংস্কারের ঘটনা কোনও অজ পাড়াগাঁয়ে নয়। মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগে পুরুলিয়া শহর ছুঁয়ে থাকা পুরুলিয়া এক নম্বর ব্লকের চাকদা গ্রামেই এমন কুসংস্কার বাসা বেঁধেছে। আর এই ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করল কুসংস্কার রুখতে এই জেলায় সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ, বিজ্ঞানমনস্ক সংগঠনগুলির ধারাবাহিক প্রচার চললেও পুরুলিয়া আছে সেই পুরুলিয়াতেই! শহর পুরুলিয়ার উপকণ্ঠে টামনা থানা এলাকার এই ঘটনায় অবশ্য এখনও কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি । কিন্ত ছেলে-বউমাদের এমন অত্যাচারের কথা পুলিশকে জানিয়েছেন ৬৫ বছরের ওই বৃদ্ধা ভাদু মাহাতো। এই খবর কানে পৌছাতেই পুরুলিয়া জেলা বিজ্ঞান মঞ্চ ওই বৃদ্ধাকে নিয়ে চাকদা গ্রামে ওই পরিবারের কাছে যায়। বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর দু’দিন বাড়িতে গিয়ে বোঝায়, ডাইনি-ভূত বলে কিছু নেই। চিকিৎসা চালিয়ে নিয়ে গেলেই নাতি সুস্থ হয়ে যাবে। এরপরেই দুই ছেলে তাঁদের মায়ের পা ধরে ক্ষমা চায়। কিন্তু ওই বৃদ্ধা আর তাঁদের ছেলে-বউমার সঙ্গে থাকতে চাইছেন না।
পুরুলিয়া জেলা বিজ্ঞান মঞ্চের সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ওই বাড়ির সঙ্গে কথা বলে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ডাইনি-ভূত কুসংস্কার বলে কিছু নেই। তবে গুণিনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” চাকদা গ্রামে এক গৃহস্থের পরিবারে আড়াই বছরের ওই নাতি কিছু দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। তাই তাঁর ঠাকুমা ফল খাইয়ে, নাতির সুস্থ কামনায় পুজো দিয়ে জল-বেলপাতা খাওয়ায়। তারপর থেকেই কথা বলা ও হাত, পা নাড়ানোর কাজে সমস্যা দেখা দেয় বলে অভিযোগ ওই বৃদ্ধার ছেলে-বউমাদের।
ফলে ওই শিশুকে বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার পর তার জ্বর কমলেও ওই শিশু খানিকটা অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, শিশুটি মেনেনজাইটিসে আক্রান্ত। আড়াই বছরের শিশু এমন অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় তারা ঝাড়খন্ড লাগোয়া পাড়া থানার রুকনির এক গুণিনের দ্বারস্থ হন। গুণিন নিদান দেন তাদের ঘরেই ‘ডাইনি’ আছে। আর ওই ‘ডাইনি’ বৃদ্ধা ভাদু মাহাতো। ওই গুণিন জানান, বৃদ্ধার জন্যই নাকি তাঁদের ঘরের মাটি ‘দূষিত’ হয়ে গিয়েছে। তবে এই মাটি পরীক্ষার জন্য ওই গুণিন চার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ।
এরপরই তাঁর দুই ছেলে-বউমা ওই নাতিকে সঙ্গে নিয়ে রাঁচিতে চিকিৎসা করতে যাবেন বলে একটি গাড়ি ভাড়া করে। সেই গাড়িতে তোলে তাঁদের বৃদ্ধা মাকেও। তারপর ওই বৃদ্ধাকে পুরুলিয়া মফস্বল থানার আইমুন্ডির কাছে একটি ফাঁকা মাঠে নামিয়ে দুই ছেলে-বউমারা লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটায় বলে অভিযোগ। তারপর বৃদ্ধা মাকে ফাঁকা মাঠে ফেলে রেখেই চলে আসে তারা। পরে ওই এলাকার বাসিন্দারা বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসা করায়। তখনই এই ঘটনা সামনে আসে। তবে এখন মা কে ‘ডাইনি’ বলে পেটানো আড়াই বছরের শিশুর বাবা অনিল মাহাতো বলেন, “বিজ্ঞান মঞ্চ আমাদের বুঝিয়েছে। আমরা ভুল করেছিলাম। তাই মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছি।” কিন্তু তবুও ভরসা পাচ্ছেন না বৃদ্ধা। তাণর কথায়, “আর আমি ছেলে-বউমাদের কাছে থাকব না। যেভাবে আমাকে ‘ডাইনি’ বলে মারধর করা হয়েছে তাতে আমি অপমানিত হয়েছি। বাকি জীবনটা এবার আত্মীয়ের বাড়িতেই কাটিয়ে দেব। তবে মাঝে-মধ্যে নাতিকে দেখতে আসব।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.