সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: রাতভর ৯৬৪১৫২৮২৪৭ নম্বরে যতবার ডায়াল করা হয়েছে। কল এনডেড। ফোনটাই যে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে গিয়েছে। শনিবার সকাল সাতটা নাগাদ ওড়িশার বালাসোর মেডিক্যালের নার্সের ফোন থেকে শাশুড়িকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে অর্চনাদেবী বলছিলেন, ‘‘মা, কাল রাত থেকে বাবুকে খুঁজে পাচ্ছি না। খুঁজে পাচ্ছি না ভাইকে। জানি না ওদের কী হল। আমার মাথায়, পায়ে ভীষণ লেগেছে। ফোনটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। আমার বাবুকে খুঁজে দাও।’’
ব্যস, ওইটুকুই কথা। তারপর থেকেই পুরুলিয়ার হুড়ার হাটতলা বাজারে অর্চনা পালের বাড়িতে উথাল পাথাল। ওই খবর শুনে তাঁর শ্বশুর অনিল পাল ১০ বছরের নাতিকে খুঁজতে ওড়িশার পথ ধরেন। আর এদিকে ঠাকুমা কাঁদু পাল নাতির জন্য কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন। ‘‘কোথায় আছিস বাবু, ফিরে আয়।’’ ঠাকুমার এমন বিলাপ শুনে ভাইয়ের জন্য তখন দুই বোন সুপ্রিয়া ও সুচিত্রার চোখেও জল। ভাইয়ের সঙ্গে তাদের মামা সঞ্জয় কুম্ভকারও যে নিখোঁজ। দুর্ঘটনার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনও খোঁজ নেই তাঁদের।
শুক্রবার সন্ধে সাতটা নাগাদ ওড়িশার বাহানাগ বাজার স্টেশনের কাছে বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়া আসা যশবন্তপুর হামসফর এক্সপ্রেসের দু’টি বগি বেলাইন হয় যায়। আর এই ট্রেনেই ছিলেন অর্চনাদেবী, তাঁর ১০ বছরের ছেলে সুমন ও অর্চনাদেবীর ভাই সঞ্জয়। ওই সময়েই পাশের লাইনে দ্রুতগতিতে ছুটে আসা হাওড়া-চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস হামসফর এক্সপ্রেসকে ধাক্কা মারে। তার পরই অর্চনাদেবীর থেকে আলাদা হয়ে যায় তাঁর ১০ বছরের সন্তান সুমন। হুড়ার কেশরগড়ের বাসিন্দা বছর চল্লিশের ভাই সঞ্জয়। অর্চনাদেবীর শ্বশুর অনিল পাল শনিবার বিকেলে বালেশ্বরে পৌঁছে তাঁর বউমার কাছ থেকে এমন কথাই জানতে পারেন। ষাটোর্ধ্ব অনিলবাবু এখন বালেশ্বর মেডিক্যাল থেকে ভদ্রক মেডিক্যাল। সেখান থেকে সরো মেডিক্যালে নাতিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
গত সোমবার অর্চনাদেবীর টিউমারের চিকিৎসার জন্য ১০ বছরের ছেলে সুমন ও ভাই সঞ্জয়কে নিয়ে ভেলোর গিয়েছিলেন। শনিবার সকাল ১০টার মধ্যে তাঁদের বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল। শাশুড়ির সঙ্গে ফোনে নিয়মিত কথা হচ্ছিল অর্চনাদেবীর। মাসখানেক আগেই অর্চনাদেবী তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে তাঁর স্বামীর জীবন। এদিকে নিজের টিউমার ধরা পড়ায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন সুদূর ভেলোরে।
কিন্তু এমন ঘটনা যে ঘটবে তা ভাবতে পারছেন না অর্চনাদেবী ও তাঁর পরিবার। হুড়ার সারদামণি শিশু বিদ্যাপীঠে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে ছোট্ট সুমন। তার দুই দিদির মধ্যে ১৪ বছরের সুপ্রিয়া অষ্টম ও ১২ বছরের সুচিত্রা ষষ্ঠ শ্রেণির হুড়া হাই স্কুলের ছাত্রী। বৃহস্পতিবার সুপ্রিয়ার সঙ্গে তার মায়ের শেষবার কথা হয়েছিল। শাশুড়ি কাঁদুদেবী বলেন, ‘‘বউমা বলেছিল রাতের বেলা খড়গপুরে নেমে কোনওভাবে বাঁকুড়া চলে আসবে। বাঁকুড়া থেকে বাসে করে বাড়ি চলে আসবে শনিবার সকাল দশটার মধ্যেই। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল!’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.