সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: শিকার উৎসবের কাছে যেন থমকে গিয়েছে ভোটের আয়োজন। এমনকী, ভোট প্রচারও। যখন রাজ্যের একাধিক জায়গায় ভোটের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে ব্যস্ত পুলিশ প্রশাসন। তখন পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির অযোধ্যা পাহাড়ে বুদ্ধ পূর্ণিমায় শিকার উৎসবে বন্যপ্রাণ হত্যা রোখাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রশাসনের কাছে। কারণ লালগড়ের বাগঘরায় রয়্যাল বেঙ্গলকে যেভাবে ‘খুন’ করা হয়েছে তাতে চাপে বন দপ্তর। তাই ওই ঘটনার আর পু্নরাবৃত্তি চায় না রাজ্য। তাই বন দপ্তরের পাশাপাশি শিকার উৎসবে ‘শিকার’ রুখতে ভোটের ময়দান ছেড়ে জঙ্গলে হানা দিচ্ছে পুলিশও। ডিএফও, এডিএফও, রেঞ্জার, বিট অফিসার সহ ৯৭০জন বনকর্মী, আশিটি যৌথ বন পরিচালন কমিটির সদস্য সেই সঙ্গে আঠারোটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রায় ৫০ জন টহল দিচ্ছেন জঙ্গলে। সেই সঙ্গে চলছে ‘শিকার’ রুখতে নানা সচেতনতামূলক প্রচার। ঝালদা বনাঞ্চলের মানভুঁইয়া ভাষায় নানান গান, কথোপকথন ও বার্তায় হোয়াটসঅ্যাপে চলছে অডিও প্রচার। লিফলেট, ব্যানার, মাইকিং, পোস্টার, দেওয়াল লিখন, তিরন্দাজি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বন্যপ্রাণকে বাঁচানোর সচেতনতার বার্তা দিয়ে শিকারিদের জঙ্গলে যাওয়ার পথ আটকাতে চাইছে বন দপ্তর। কিন্তু তারপরেও শনিবার দুপুর থেকেই তির-ধনুক, বল্লভ, বর্শা, জাল নিয়ে অযোধ্যা বনাঞ্চলে ঢুকে গিয়েছেন শিকারিরা। অন্যান্য বারের মত এবারও ভিন রাজ্য থেকে শিকারিরা পা রেখেছেন অযোধ্যা পাহাড়ে। ফলে পাহাড় জুড়ে থাকা পাঁচটি ব্লক বাঘমুণ্ডি, বলরামপুর, আড়শা, ঝালদা ১ ও ঝালদা ২–এ যেন থমকেই গিয়েছে ভোটের প্রচার। পুরুলিয়ার ডিএফও রামপ্রসাদ বদানা বলেন, “এই উৎসবে যাতে শিকার রোখা যায় সেইজন্য বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। তাঁরা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। বন্যপ্রাণ ও জঙ্গলকে বাঁচাতে আমাদের সারাবছর নানা প্রচার চলে। শিকার উৎসবের প্রাক্কালে তা আরও জোরদার ভাবে চলছে।”
অযোধ্যা পাহাড়ে এই বুদ্ধ পূর্ণিমায় শিকার উৎসবে বন্যপ্রাণ হত্যা রুখতে সাম্প্রতিককালে ফি বছরই নানা পদক্ষেপ নেয় বনদপ্তর। কিন্তু কোনওবারই শিকারিদের শিকার থেকে বিরত রাখতে পারে না। ফলে বেঘোরে প্রাণ হারায় চিতল হরিণ, বনশুয়োর, বনবেড়াল, ময়ূর-সহ নানা বন্যপ্রাণ। শুধু তাই নয়, বনদপ্তরের চোখের সামনে তির বা বল্লভ বিদ্ধ বন্যপ্রাণ সমেত শিকারীদের দেখতে পেলেও বনদপ্তর সেভাবে কোন আইনত ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ। কিন্তু এবার লালগড়ে রয়্যাল বেঙ্গলের মৃত্যুর পর শিকার রুখতে বনদপ্তরের পদক্ষেপ আগের বছরগুলির চেয়ে আরও বেশি। বনদপ্তরের পুরুলিয়া বিভাগের মধ্যে পুরুলিয়া বনাঞ্চল পড়লেও কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগের বান্দোয়ান এক বনাঞ্চলেও বন্যপ্রাণকে বাঁচানোর বার্তা নিয়ে মাইকিং চলছে। মূলত বুদ্ধ পূর্ণিমায় শিকার উৎসব হলেও এই উৎসবের রেশ ছুঁয়ে থাকে প্রায় তিনদিন। ইতিমধ্যেই ঝালদা বনাঞ্চলের হেঁশলাতে প্রশাসন, পুলিশ ও বনদপ্তর মিলিয়ে এলাকার মানুষকে শিকার থেকে দূরে রাখতে শপথ করিয়েছে। অযোধ্যা পাহাড়েও বন দপ্তর স্কুল পড়ুয়া-সহ গ্রামবাসীদের নিয়ে দু’দিন ধরে এই শিকার উৎসবে বন্যপ্রাণকে বাঁচাতে পদযাত্রা করে। তাছাড়া পুরুলিয়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন) ধৃতিমান সরকারের নেতৃত্বে ওই এলাকায় টহলও চলছে। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন হাজার-হাজার শিকারিকে রুখতে পারবে তো প্রশাসন? ধামসা-মাদল আর কিঁদরীর সুরে যে এই উৎসবের গান-ই ভেসে আসছে অযোধ্যার শাল-শিমুলের বনাঞ্চল থেকে।
এদিকে শিকার উৎসবে ছন্দপতন ঘটাতে পারে হাজারিবাগের বুনো হাতির দল! উৎসবের আগেই যে পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির অযোধ্যা বনাঞ্চলের গোবরিয়ার জঙ্গলে ঢুকেছে বারোটি হাতি। তাই বন দপ্তর মাইক ফুঁকে এই উৎসবে বন্যপ্রাণ হত্যা বন্ধের বার্তার পাশাপাশি এই হাতির দল থেকে সাবধানে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে। জানা গিয়েছে, কয়েকদিন আগে ওই হাতির দলটি এই পাহাড়ের গোবরিয়ার জঙ্গলে ঢোকে। দলে থাকা দাঁতালটি চারদিক ঘুরে বেড়ানোয় সমস্যায় পড়েছে বন দপ্তর। কারণ, শিকার উৎসবকে ঘিরে শুধু শিকারিরা নন, বহু পর্যটক এখন পাহাড়ে রয়েছেন। তাঁরা উৎসবে মাততেই এইসময় পাহাড়ে আসেন। এবার শিকার উৎসব উইকএন্ডে পড়ায় পর্যটকের সংখ্যা আরও বেড়েছে। ফলে একদিকে শিকার উৎসবে বন্যপ্রাণ হত্যা রোখার পাশাপাশি হাতির দলকে সামলানোর করতে হচ্ছে। কার্যত কালঘাম ছুটছে বন দপ্তরের অযোধ্যা বনাঞ্চলের।
ছবি: অমিত সিং দেও
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.