সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ফের জনসচেতনতা প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠল লোকসংগীত৷ ঝুমুরের সুরে গান বেঁধে পুরুলিয়ার গাঁ-গঞ্জে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন এক যুবক। খর তাপে গ্রামে ঘুরে ঘুরে চলছে মধুসূদন মাহাতোর প্রচার৷ ঢোলের তালে গান উঠছে – ‘ও যে পড়াশুনা করব মোরা/ থাকব হে স্বাধীন এখন/ আঠারো না হলে পরে/ বিয়েটা যে অশোভন।’
সকাল হতেই পুরুলিয়া মফস্বল থানার কাটাবেড়া গ্রামের মধুসূদন মাহাতো ঢোল নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন৷ তারপর একের পর গ্রাম ঘুরে বাড়ি ফিরছেন সাঁঝবেলায়। সাবেক মানভূমের এই জনপদকে বাল্যবিবাহ মুক্ত করতেই এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তিনি। নিজের তৈরি ঝুমুর গানের ভিডিও বানিয়েছেন। সেই ভিডিও মাধ্যমে সোশ্যাল সাইটেও চলছে জোরদার প্রচার৷
বছর চল্লিশের মধুসূদন দীর্ঘদিন থেকেই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। জনসচেতনতায় জোর দিয়ে ডাইনি-ওঝা-ঝাড়ফুঁকের মতো সামাজিক ব্যধি থেকে পাহাড়-জঙ্গলে ঢাকা এই জনপদকে অনেকটাই মুক্ত করেছেন। এবার তাঁর নয়া চ্যালেঞ্জ – বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণরূপে রুখে দেওয়া। আসলে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই প্রান্তিক জেলায় মেয়েদের বয়স বারো, তেরো হলেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। এটাই যেন অলিখিত নিয়ম। এর অন্যথা হলে, সেই মেয়েকে বা তার পরিবারকে সমাজে অপমানের মুখে পড়তে হয়৷ তাছাড়া কোনও কিশোরী বাবা-মায়ের বিয়ের প্রস্তাবে সায় না দিলে তাকে ভিন রাজ্যে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনাও চলে।
ইদানিং অনেক ক্ষেত্রেই কিশোরীরা ওই বয়সে বিয়ে করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতিবাদ করছে। আবার বেশ কিছু জায়গায় অভিভাবকদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আঠারো বছরের আগেই বিয়ে করে নিজেদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলেও দিচ্ছেন কেউ কেউ৷ বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সমাজকল্যাণ দপ্তর, পুলিশ ও চাইল্ড লাইন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও গাঁ-গঞ্জের ওই সব কিশোরীর কান্না তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই ফি দিন বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটতেই থাকে এই জেলায়। যার সঙ্গে রাজস্থানের পরিস্থিতির তুলনা করছে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা৷
এসবের মাঝেই অবশ্য বাল্যবিবাহ রোধে আজ দেশের কাছে মডেল রাজ্যের প্রান্তিক জেলা পুরুলিয়া। নিজেদের উদ্যোগে বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়ার তালিকাটা বেশ লম্বা। আফসানা খাতুন, সুনীতা মাহাতো, রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী-সহ একাধিক নাম। তাই দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল এই কিশোরীদের বলেছিলেন ‘সমাজ পরিবর্তনের দূত।’ আফসানা, সুনীতা, রেখার ওই প্রতিবাদের ভাষা দেখেই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল জেলায়। চালু হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাশ্রী প্রকল্পও। কিন্তু এখনও এই জেলার মানুষকে সচেতন করা যায়নি। তাই পুরুলিয়ার মতো এই লোকসংস্কৃতির দেশে লোকগান ঝুমুরকে ব্যবহার করেই মানুষকে সচেতন করতে চান মধূসদূন। তাঁর কথায়, ‘এই জেলার মানুষের সঙ্গে মিশে রয়েছে ঝুমুর–টুসু। জীবনের হাসিকান্নার মতই লোকগান মানভূমের হৃদয়জুড়ে আছে। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ঝুমুর গানকেই হাতিয়ার করেছি।’ তাই ঝুমুরের সুরে মধুসূদন বলছেন, ‘ আঠারো বছর আগে বিয়ে/ শরীর পূর্ণ নয় তখন/বাচ্চাকাচ্চা হলে পরে/শরীরে ধরে ভাঙন/ কম বয়সে বিয়ে হলে/বাচ্চা হয়রে কম ওজন/ কোন কোন সময় দেখো/মা–বাচ্চারও হয় মরণ।’ এরপর মধুর আরও সংযোজন, ‘বাল্যবিবাহ করছি হে আমরা বারণ/ কোন কোন সময় মোরা, ডাকি পুলিশ–প্রশাসন।’
ছবি: অমিত সিং দেও
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.