সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: এ কাহিনি এক রিকশাওয়ালা আর ‘মাধবী’র। গানের জগত থেকে তাঁরা নেমে এসেছেন বাস্তবের মাটিতে। তাই এই কাহিনি রিকশাওয়ালা বিশ্বনাথ আর তাঁর ‘মাধবী’ কমলার। সমাজ, আইন, লোকলজ্জা কোনও বস্তুত কিছুরই তোয়াক্কা না করে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দিলেন ৩০ টা বছর। কাগজ-কলম, অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে না করলেও পরস্পর এতটাই সংলগ্ন যে অক্লেশে নিজের ‘রায়’ পদবি বাদ দিয়ে কমলা গ্রহণ করে নিয়েছে বিশ্বনাথের ‘সহিস’ পদবি। পুরুলিয়ার (Purulia) কেতকাডিতে বিশ্বনাথ-কমলার এই প্রেমের জীবনে বস্তুত সারাজীবনই ভালোবাসার মরশুম।
‘আমি যে রিশকাওয়ালা/ দিন কি এমন যাবে?/ বলি কি ও মাধবী/ তুমি কি আমার হবে?’, গলি থেকে রাজপথ – রিকশা চালাতে চালাতে কখনও আপনমনে এই গান গুনগুনিয়ে উঠেছেন কি না, জানা নেই। তবে মাধবী ওরফে কমলা কেতকাডির রিকশাওয়ালা (Ricksaw Puller) বিশ্বনাথ সহিসেরই হয়েছেন। গলি থেকে শহরের রাস্তা, যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে রিকশা। আর সেই রিকশার পিছন-পিছন হাঁটছেন এক মহিলা। কখনও বা রিকশার গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রীতিমতো দৌড়চ্ছেন তিনি। দিনের পর দিন এই ছবি দেখতে অভ্যস্ত ছিল শহর পুরুলিয়া।
ভালোবাসার টানে আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগে এক রিক্সাওয়ালার হাত ধরেছিলেন সম্ভ্রান্ত রায় পরিবারের এক ব্রাহ্মণ মহিলা কমলা। সামাজিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি তারা। কিন্তু ভোটার থেকে আধার কার্ড, পদবি ‘রায়’ মুছে এসেছে ‘সহিস’। ভালোবাসা নামের শক্ত দেওয়ালের কাছে জাতের বাছবিচার উবে গিয়েছে নিমেষে। তিরিশটা বছর, আজও তাঁরা একসঙ্গে থাকেন। কোনও অবস্থাতেই ওই রিক্সাওয়ালার হাত ছাড়েননি মহিলা। এখনকার ভাষায় যাকে বলে লিভ-ইন।
ভ্যালেন্টাইনের প্রাক্কালে এই ভালোবাসার গল্প আজকের দিনে রীতিমতো দৃষ্টান্ত। যেখানে আজকালকার দিনে প্রেমের সম্পর্কগুলোর মধ্যে অযথা বারবার ‘ব্রেকআপ’ শব্দ ঝড় তোলে, সেখানে এই ভাঙা শরীর নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে যান। চরম অভাবেও একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। আজ সেই রিকশা, যাত্রী বোঝাই রিকশার পিছনে দৌড়নোর ছবি এই শহর আর দেখতে পায় না ঠিকই। কিন্তু ভালোবাসার চুম্বকটানে আবদ্ধ আড়াই দশক পরেও এই শহর দেখছে, এখনও অলিগলি পেরিয়ে শহরের জনবহুল রাস্তায় হাত ধরে হাঁটছেন বিশ্বনাথ-কমলা। একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছেন। আবার প্রকাশ্য রাস্তায় ঝগড়াও করছেন। তাঁদের চিৎকার-চেঁচামেচিও শোনা যায়। কিন্তু দিনের শেষে চার হাত একই। এক মুহূর্তও একে অন্যকে চোখের আড়াল করতে চান না। এই শহর তাঁদের মধ্যে দিয়ে চাক্ষুষ করেন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে।
বিশ্বনাথ সহিস ও কমলা সহিস। শহর পুরুলিয়ার দুলমি থেকে যে রাস্তা কেতকার দিকে নেমেছে। পুকুর শেষে কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে নেমে গিয়েছে রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে ওই জনপদে নেমে বাঁ হাতে কিছুটা গিয়েই একের পর এক দালান বাড়ির সামনে ঠিক বাঁ-দিকে একটা ঘুপচি ঘর। খাতায়-কলমে ঠিকানা কেতকাডি। সেখানেই বাস তাঁদের। যে ঘরে সূর্যের আলো ঢোকে না। লম্ফ জ্বালিয়ে একে অপরের অবস্থান বোঝা যায়। সেখানেই ভাঙা ডেচকিতে চাল ফুটিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেন তাঁরা। বিশ্বনাথ-কমলার লাভ স্টোরি নিয়ে এই শহরে নানা কথা হলেও সরকারি প্রকল্পের সুযোগ পাইয়ে দিতে কেউ এগিয়ে আসেননি। এক চিলতে ঘুপচি ঘরটাও যে বহু কষ্টে জুটেছে।
৬২ বছরের বিশ্বনাথের কথায়, “বাবা-মা মারা গিয়েছে অনেক কাল লাগেই। এক মাত্র ভাই মুটের কাজ করতো। সেও মারা গিয়েছে। রিকশা চালিয়ে এক দূর সম্পর্কের দাদুর কাছে থাকতাম। সেখানেই কমলার সঙ্গে পরিচয়। অসুস্থ ছিল সে। হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলেছিলাম। তখন আমার কেউ কোথাও নেই। বিয়েও করিনি। সবাই বলল, কমলাকে তোর কাছে রেখে নে। তাই রেখে নিলাম। জড়িয়ে গেলাম ভালোবাসায়। তারপর এই জীবন দিয়ে কত ঝড়-ঝাপটা বয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও আমরা একসাথে পথ চলছি। বিয়েটা আর করা হয়নি বটে। কিন্তু কমলা ‘রায়’ থেকে ভোটার কার্ডে আমার পদবির সঙ্গে মিলিয়ে ‘সহিস’ হয়ে গিয়েছে। আধার কার্ডেও তাই।” বিশ্বনাথের কথা শেষ না হতেই মুখের কথা কেড়ে নেন কমলা। বলেন, “আমার বাবা পুলিশ ছিল। চার বোনের মধ্যে ছোট ছিলাম আমি। আমার বিয়েটা ঠিকঠাক হয়নি। আমার যে স্বামী, তার আরেকটা ঘরনি ছিল। কী বলব আর? তারপর সেখানে গিয়ে কবে মারা গিয়েছে আমি জানি না। এখন বিশাই আমার জীবন। ও-ই আমার ভরসা। এই বড় পৃথিবীতে ও-ই তো মর্যাদা দিয়েছে।”
এলাকার বাসিন্দা শান্তময় মাহাতো, সরস্বতী বাউড়ি বলেন, “এদের প্রেমকাহিনি এই শহরে রাধা-কৃষ্ণ, মিঠুন-শ্রীদেবী জুটি নামে পরিচিত। বিয়ে করেননি, কিন্তু ভালোবাসার টানে এক ছাদের তলায় থাকছেন দীর্ঘদিন ধরে।” তাইতো এলাকার মানুষ বিশ্বনাথের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘বিশা-বিশি’ বলে থাকেন। হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে কমলাকে সুস্থ করে তুলেছিলেন এই রিকশাওয়ালা। এই গল্প যে অনেকটাই রোমের বাসিন্দা, খ্রিস্টধর্মের যাজক, চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মতো। রোমের তৎকালীন সম্রাট নিষিদ্ধ খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের জন্য সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে বন্দি করে রাখেন। সেখানে এক দৃষ্টিহীন মহিলার চিকিৎসা করে তাঁর দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন ভ্যালেন্টাইন। কিন্তু তার জন্য ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। তার পর ছড়িয়ে গিয়েছিল সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম। একইভাবে তরুণী কমলাকে সুস্থ করে নতুন জীবনে ফিরিয়েছিলেন রিকশাওয়ালা যুবক বিশ্বনাথ। নিজেও পেয়েছিলেন অন্য জীবনের স্বাদ।
নাগরিক সমাজের লিভ-ইন শব্দ থেকে তাঁরা শতহস্ত দূরে। আইনের চোখে রেজিস্ট্রেশনও নেই। প্রয়োজনও পড়ে না। কারণ আমাদের গল্পের নায়ক-নায়িকার তিরিশ বছরের অবিবাহিত জীবনের ভিত তো ভালোবাসা, পৃথিবীর সর্বোত্তম, মহোত্তম অনুভূতি। বয়সের ভার নিয়ে উভয়েই নতজানু হন ভালোবাসারই কাছে।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.