ছবি: সুমিত বিশ্বাস।
সুমিত বিশ্বাস, অযোধ্যা পাহাড় (পুরুলিয়া): জেলা পুলিশের ‘আস্থা’ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের মানুষের কাছে ক্রমশ আস্থাশীল হয়ে উঠছে পুরুলিয়া (Purulia) জেলা পুলিশ। সঙ্গে প্রশাসনও। তাই মাও শহিদ সপ্তাহের (২৮ জুলাই- ৩ আগস্ট) মধ্যেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের রাঙা গ্রামে রবিবার পুলিশের খাটিয়া বৈঠক থেকে আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীরা (Maoists) উন্নয়নের বার্তা দেওয়া হল। একদা অযোধ্যা পাহাড়ের মাওবাদী এরিয়া কমান্ডার তথা বর্তমানে রাজ্য পুলিশের স্পেশ্যাল হোম গার্ড আনন্দ কুমার ওরফে নন্দ কুমার ছাড়াও পুলিশের এই বৈঠকে হাজির থেকে উন্নয়নের শরিক হলেন একদা মাও শীর্ষ নেতা তথা সিপিআই(মাওবাদী) রাজ্য কমিটির সদস্য রঞ্জিত পাল।
এক সময় মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের দু’নম্বর নেতা ছিলেন এই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, পুলিশের ত্রাস রঞ্জিত। কমবেশি ১০ টি নাম নিয়ে এই পাহাড়ে মাওবাদী কার্যকলাপ চালাতেন। নীতীন ওরফে রাহুল ওরফে সঞ্জয় ওরফে রোহিত ওরফে রাজা ওরফে তড়িৎ ওরফে পশুপতি ওরফে পনরু ওরফে প্রভাতজি। বদলে যাওয়া জঙ্গলমহলে বর্তমানে কলকাতা পুলিশের এসটিএফের স্পেশ্যাল হোমগার্ড রঞ্জিত পালকে এদিন পুলিশের এই উন্নয়ন (Development) বৈঠকের মঞ্চে দেখা যায়। তিনি যে এখন পুলিশেরই সহকর্মী!
একসময় যে মাওবাদীরা সরকার বিরোধী কথা বলে মানুষজনকে বিপথে পরিচালিত করত। এখন তারাই সমাজের মূল স্রোতে সরকারি মঞ্চ থেকে উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছেন। অতীতে এই মাও শহিদ সপ্তাহ মানেই পাহাড় জুড়ে মাও পোস্টার-ব্যানার ছিল। পুলিশের টহল। আর আজ পুলিশের ‘আস্থা’-র ছাতার তলায় উৎসবের মেজাজে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। সঙ্গে পংক্তি ভোজন। আসলে গত তিন বছর ধরে এই অযোধ্যা পাহাড়ে নানান স্থানীয় ইস্যুতে অশান্ত করার চেষ্টা করেছিল মানুষজন। বহিরাগতরাও এই পাহাড়ে পা রেখে উসকে দিয়েছিল বারে বারে। তাই একের পর এক ইস্যু তৈরি হয়েছিল। জমি দখল হয়ে যাওয়া, বামনি ফলসের ‘অধিকার’, টুরগা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হলে পাহাড়ের ক্ষতি। এইসব ইস্যুকে সামনে রেখে অযোধ্যা পাহাড়কে (Ayodhya Hill) আবার তাতানোর চেষ্টা চলছিল আগের মতই। কিন্তু সাধারণ প্রশাসন অযোধ্যাকে ‘পাখির চোখ’ করে এগিয়ে যেতে থাকে।
রাজ্যে পালা বদলের পর যে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। তার আরও ব্যপ্তি ঘটে পর্যটন, চাষাবাদ, প্রাণীপালন-সহ নানা স্বনির্ভর কর্মকাণ্ডে। আর এর সঙ্গেই গত বছরের শেষের দিকে যুক্ত হয় পুরুলিয়া জেলা পুলিশের ‘আস্থা’ প্রকল্প। যার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের ৭৮ টি গ্রামে একেবারে ঘরে ঘরে গিয়ে সমস্যার খোঁজ শুরু করে পুলিশ। কোন পরিবার সরকারি প্রকল্পের আওতার বাইরে, কোথায় কী সমস্যা রয়েছে, সেসব খুঁজে বের করে চটজলদি সমাধান করে দেওয়া হচ্ছে। অযোধ্যা পাহাড় জুড়ে এখন পুরুলিয়া জেলা পুলিশের তরফে এই কাজটাই করে যাচ্ছে আয়দেয়া (অযোধ্যা) উন্নয়ন গ্রুপ। এই গ্রুপে রয়েছেন ৩৮ জন আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী। যারা এখন রাজ্য পুলিশের খাতায় স্পেশ্যাল হোমগার্ড। এখানকার মানুষের মন পেতেই পুরুলিয়া জেলা পুলিশের এই উন্নয়ন শাখা সাঁওতালি ভাষায় অযোধ্যার এমনই নামকরণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘বন্ধু’ পাতাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে উঠে আসছে নানান সমস্যার কথা।
প্রশাসন বা রাজ্য চায় না এই পাহাড় আবার আগের চেহারায় ফিরে যাক। তাই এই ‘আস্থা’ প্রকল্পের অধীনেই ‘পথের দিশা’ নাম দিয়ে এলাকার যুবক-যুবতীদের চাকরি পাইয়ে দিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন স্বয়ং পুলিশ আধিকারিকরাই। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার (SP) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অযোধ্যা পাহাড়ের উন্নয়নই আমাদের ‘পাখির চোখ।’ সরকারি কাজে যারা বাধা দেবে এই বিষয়গুলিকে প্রশাসনিক ভাবেই মোকাবিলা করবে প্রশাসন। এখানকার কোনও মানুষজন যাতে সরকারি প্রকল্পের বাইরে না থাকেন সেই কারণেই আমাদের মূলত ‘আস্থা’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আমরা গ্রামে গ্রামে খাটিয়া বৈঠক করে যেমন সমস্যা জেনে নিই। তেমনই এই কাজে আমাদেরই কর্মীরা ঘরের দুয়ারে গিয়েও সমস্যার খোঁজ করেন। সেই সমস্যার চটজলদি সমাধান হয়।”
পুরুলিয়া জেলা পুলিশ এই এলাকার পর্যটন, হস্তশিল্প এখানকার সংস্কৃতিকে ভর করেই এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার বদল ঘটাতে চায়। তাই আগামী ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে পাহাড় জুড়ে ফুটবল টুর্নামেন্ট করবে পুলিশ। যা শেষ হবে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে। আগামী দিনে এই এলাকার ফুটবল প্রতিভাকে কলকাতায় তুলে ধরতে এখানে স্থায়ীভাবে ক্যাম্পও হবে। বেসরকারি বিনিয়োগে হোম স্টে-র মাধ্যমে মানুষজনের অর্থনীতি যাতে মজবুত হয় তার ব্যবস্থাও করবে পুলিশ। এই পাহাড়ের সবুজ ও বন্যপ্রাণ রক্ষা সেই সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জনের জন্য ম্যারাথন দৌড়ের মতো কর্মসূচিও নেবে আগামী কয়েক মাসে। ‘পথের দিশা’-র শ্রেণিকক্ষকে স্মার্ট ক্লাসরুমের রূপ দিয়ে সেখানে গ্রন্থাগারও তৈরি করা হবে। এদিন খাটিয়া বৈঠকের মঞ্চ থেকেই তা জানান পুলিশ সুপার। এদিন এই উন্নয়ন বৈঠকের মধ্যেই বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকরা সরকারি প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা তুলে ধরেন। সেখানেই চক্ষু শিবির করে অনেককে চশমা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে ফুটবল ও গাছের চারা বিতরণ। পুলিশের ওই মঞ্চ থেকেই এই পাহাড়ে সবুজায়নেরও বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.