পলাশ পাত্র, তেহট্ট: কফিন জাপটে কাঁদছেন মা, বোন। বছর পাঁচের কন্যা কেঁদেই চলেছে। মাস খানেক মামা তাকে তেহট্টর বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেছিল৷ ভাগ্নী সম্প্রীতি অবশ্য বুঝতেও পারছে না, মামা শহিদ হয়েছে। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ তার মামার জন্য ‘বদলা’ চেয়ে পথে নেমেছে। মোমবাতি মিছিল করছে। সম্প্রীতি অঝোরে কেঁদে চলা মা, দিদা আর বাবা – সকলের কাছে একটাই প্রশ্ন নিয়ে ঘুরছে, মামা কি আর ফিরবে না? উত্তরে শুধুই চোখের জল মুছছেন বাবা সমাপ্ত, মা ঝুম্পা বিশ্বাস। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় শহিদ নদিয়ার হাঁসপুকুরিয়ার সুদীপ বিশ্বাসের কফিনবন্দি দেহ শনিবার রাতের দিকে বাড়িতে পৌঁছতেই দেখা গেল এমনই টুকরো সব ছবি।
হাহাকারের মাঝে কফিনবন্দি হয়ে ফিরল উলুবেড়িয়ার শহিদ জওয়ান
মামা বাড়িতে ফোন করলে সম্প্রীতিও কথা বলত। চোখের সামনে মেয়েটা দু’দিন ধরে দেখছে, বাড়িটায় কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। মা, ঠাকুমা এখনও পর্যন্ত কিছু খায়নি। কাঁপতে কাঁপতে তাঁরা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। অভাবের সংসারে খুব কষ্ট করে গ্রামের স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সুদীপ দেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। তাঁর মা মমতা বিশ্বাস কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘বাড়িটা ঠিক করে ও বিয়ে করবে বলেছিল। সেইমতো বৈশাখ মাস থেকে বাড়ি নির্মাণের কাজে হাত দেয়। পাত্রীও দেখা হচ্ছিল। ও ফাল্গুন মাসেই আসবে বলেছিল।’ সকলের আদরের টোটন এভাবে চলে যাবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশীরা। ৮ বছর আগে পাশের গ্রাম চকবিহারীতে বিয়ে হওয়া সুদীপের বোন ঝুম্পা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘এর বদলা চাই। আমরা কি শুধু কেঁদে যাব? এর বদলা কবে শুনতে পাব? বদলার কথা শুনতে চাই। শুনতে চাই আমার দাদাকে যারা শেষ করেছে, তারা শেষ হয়েছে।’ বাবা সন্ন্যাসী বিশ্বাসের চোখে জল। গোটা বিশ্বাস বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা নেই। সবে হওয়া ছাদ ঢালাইয়ের বাঁশের ফাঁকেও যেন বিমর্ষতা।
‘রক্ত দিন, প্রাণ বাঁচান’ – জীবনের মহান বার্তা নিয়ে ভ্রমণে নদিয়ার যুবক
ফাল্গুন মাসেই বাড়ি ফেরার কথা ছিল সিআরপিএফ-এর ৯৮ নং ব্যাটেলিয়নের জওয়ান সুদীপ বিশ্বাসের। ফাল্গুনেই এল, তবে কফিনবন্দি হয়ে। পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় নিথর, নিস্পন্দ হয়ে। শনিবার রাত প্রায় ৯টা নাগাদ দেহ পৌঁছানোর পর ঘন্টাখানেক বিশ্বাসপাড়া বারোয়ারির সামনের ফাঁকা জমিতে রাখা হয়। সেখানে একটি মঞ্চ করা হয়। একাধিক বাড়ির মাঝের এই জমিতে রাখা হয় কফিনবন্দি দেহ। মঞ্চের ওপর জ্বলজ্বল করছে শহিদের সুদীপ বিশ্বাসের ছবি। সেখানে লেখা – অমর শহিদ সুদীপ বিশ্বাস। শোকাহত হাঁসপুকুরিয়ার গ্রামবাসী। শেষশ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেছেন হাজার হাজার মানুষ। বাঁশ দিয়ে গোটা এলাকাটা ঘিরে দেওয়া হয়। প্রশাসন ও পঞ্চায়েতের তরফ থেকে মাঠে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। সেই বাঁশের ব্যারিকেড না ভেঙ্গেই সুশৃঙ্খল ভাবে হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে গ্রামবাসীরা বীর যোদ্ধা সুদীপকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান। তাঁদের মুখে স্লোগান – ‘সুদীপ বিশ্বাস অমর রহে। পাকিস্তান মুর্দাবাদ।’ এই মাঠেই তাঁকে গান স্যালুট দেওয়া হয়। এদিন উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস, স্থানীয় বিধায়ক তাপস সাহা, কল্লোল খাঁ-সহ অনেকেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.