সন্দীপ মজুমদার, উলুবেড়িয়া: সংসারে শত অভাব। মায়ের জন্য ওষুধ কেনার গুরু দায়িত্ব। তবুও রাস্তায় পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা কাজে লাগালেন না উলুবেড়িয়ার যুবক কার্তিক ধাড়া। বরং টাকার ব্যাগটি তিনি সোজা থানায় জমা দিয়ে দিলেন। মায়ের ওষুধও কিনলেন, তবে ধার করে। বোঝালেন, মায়ের ওষুধের চেয়ে সততার দাম এখনও অনেকটাই চড়া।
বাড়িতে মায়ের অসুখ। ওষুধ কেনার টাকা নেই। রবিবার সকালে কোনওক্রমে ২০০ টাকা জোগাড় করে ওষুধ কিনতে দোকানে গিয়েছিলেন ঝামটিয়ার বছর চব্বিশের যুবক কার্তিক। জয়পুর মোড়ের কাছে ওভারসিজ ব্যাংকের সামনে কার্তিকের চোখে পড়ে, রাস্তায় এক গোছা টাকা। বান্ডিলটা কুড়িয়ে নেন তিনি। গুনে দেখেন, বান্ডিলে সাড়ে আট হাজার টাকা রয়েছে। অনেক টাকা। চাইলেও সেখান থেকে মায়ের ওষুধ কেনার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কার্তিক নিতেই পারতেন। কিন্তু না, সে পথে পা দেননি তিনি। প্রথমে আশেপাশের সকলের কাছে ওই টাকার বান্ডিল কার, তার খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবেন কার্তিক। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে হয়, এভাবে জানার চেষ্টা করলে, সকলেই ওই টাকা নিজের বলে দাবি করতে পারেন। তাতে প্রকৃত টাকার মালিকের হাতে তা তুলে দেওয়া যাবে না। বছর চব্বিশের যুবকের আরও উপলব্ধি হয়, নিজে যেমন টাকার অভাবে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে সমস্যায় পড়ছেন, এই টাকার মালিকও হয়ত সেরকমই কোনও কারণে এত টাকা জোগাড় করেছিলেন। হয়তো তাঁর বাবা কিম্বা মায়ের চিকিৎসার জন্য এই টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কোনওভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ রাস্তায় পড়ে গিয়েছে। এসব ভেবে কার্তিক ওই টাকা প্রকৃত দাবিদারের হাতেই তা ফেরত দেওয়ার জন্য সোজা জয়পুর থানায় চলে যান। সেখানে তিনি পুলিশের হাতে টাকার বান্ডিলটা তুলে দিয়ে জানান, রাস্তার এই বান্ডিল তিনি কুড়িয়ে পেয়েছেন। পুলিশ যেন প্রকৃত ব্যক্তির কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এরপর থানা থেকে বেরিয়ে কার্তিক ওষুধের দোকানে যান। নিজের কাছে থাকা ২০০ টাকা জমা দিয়ে সব ওষুধ কেনেন ধারে।
[পকেটে কার্ড, আসানসোলের গ্রাহকের টাকা উঠল ঝাড়খণ্ডের এটিএম থেকে]
কথায় বলে, অভাবে নাকি স্বভাব নষ্ট হয়। এই কথাকে ভেঙে দিয়েছেন কার্তিক ধাড়া। তাঁর সততার এই নজির দেখে আপ্লুত পুলিশ আধিকারিকরা। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, এমনই একটি পরিবারের সদস্য কার্তিক। বাবা, মা, ভাই, বোনদের নিয়ে তাঁদের অভাবের সংসার। দারিদ্র কার্তিকের শরীরে ছাপ ফেলতে পারলেও, মানসিকতায় এতটুকুও আঁচড় কাটতে পারেনি। এর আগেও সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে উলুবেড়িয়ার কার্তিক ধাড়ার নাম। স্বাধীনতা দিবস, নেতাজির জন্মদিন অথবা প্রজাতন্ত্র দিবসে এসাকাবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে এই যুবক জাতীয় পতাকা, ফুল, বেলুন ও নেতাজির ছবি দিয়ে নিজের সাইকেল সাজিয়ে ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় নিহত জওয়ান বাবলু সাঁতরার মৃতদেহ যেদিন বাউড়িয়ায় তাঁর বাড়িতে পৌঁছেছিল, সেইদিনও কার্তিক তাঁর ঝামটিয়ার বাড়ি থেকে বাবলু সাঁতরার ছবি বুকে নিয়ে সাইকেলে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাবলু সাঁতরার বাড়ি। কিছু দূর যাওয়ার পর সাইকেল খারাপ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ২১ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটেই শহিদকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন কার্তিক ধাড়া। এমন ছেলেই সমাজের প্রকৃত নাগরিক, প্রকৃত শিক্ষকও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.