কলহার মুখোপাধ্যায়: একজনের স্বামী নিজে হাতে তাঁকে আড়কাঠির হাতে তুলে দিয়েছিল। অপরজনের প্রেমিক জোর করে যৌনপল্লিতে ঢুকিয়ে পালিয়েছিল। দুই মেয়েই ক্যানিংয়ের। একজনকে আগ্রার একটি যৌন পল্লি থেকে উদ্ধার করা হয়। অপরজনকে মুম্বইয়ের একটি তৃতীয় শ্রেণির হোটেল থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। সিনেমায় এমন হয়। যৌনপল্লিতে থাকার সময়কার গল্প শুনলে ‘লক্ষ্মী’ বা ‘লাভ সোনিয়া’র দৃশ্য মনে পড়তে পারে। তারপর অবশ্য ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। বর্তমানে শান্তিতে ঘরকন্না করছেন দুই তরুণী। তবে ঘটনাটা এমন নাও হতে পারত। সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে এই দুই মেয়ের লড়াই যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনই পুলিশের তৎপরতা, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদিচ্ছা এবং রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের সহযোগিতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছেন এই দুই তরুণী।
বিত্ত নিগমের তরফ থেকে মোটা টাকার চেক তুলে দেওয়া হয় এই দু’জনের হাতে। একজন তা দিয়ে মনোহারি দোকান সাজিয়ে ব্যবসা করছেন। অপর জন মুদির দোকান খুলে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সবাই মিলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে যৌনপল্লির অন্ধকার ঘরই তাঁদের পাকাপাকি বাসস্থান হতে পারত বলে দুই মহিলাই তাঁদের মতামত জানিয়েছেন।
কী ঘটেছিল তাঁদের সঙ্গে? দুই মহিলারই বাড়ি ক্যানিংয়ে। একজন থাকেন ক্যানিং ২ ব্লকে। ২৪ বছরের তরুণী। কয়েক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। একদিন কলকাতা ঘোরাতে নিয়ে যাবে বলে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোয় স্বামী। ওই তরুণী জানিয়েছেন, স্টেশনে নেমে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় তাঁর স্বামী। কিছুক্ষণ গল্পগুজবের পর এক মিনিটের মধ্যে আসছি বলে সেই যে স্বামী চলে গেল, তারপর তার আর সন্ধান মেলেনি। অচেনা লোকটি তাঁকে নিয়ে ট্রেনে চেপে আগ্রা নিয়ে যায়। ট্রেন থেকে নামার পর এক যৌনপল্লিতে রেখে পালিয়ে যায় সে। সেখানে অজানা এক পরিবেশে যন্ত্রণাময় জীবন কাটাতে বাধ্য হন তিনি। তারপর যৌনপল্লিতে তাঁর ঘরে আসা এক খদ্দেরের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাঁর মোবাইল থেকে দেশের বাড়িতে নিজের দাদাকে ফোন করেন। পরিস্থিতির কথা বিশদে জানান। তারপর ক্যানিং ২-এর একটি থানায় এফআইআর দায়ের করেন তরুণীর দাদা। পুলিশ তদন্ত শুরু করে হানা দেয় আগ্রায়। উদ্ধার করা হয় তরুণীকে। তারপর ক্যানিং ফিরে বারসা বীরাঙ্গনা সেবা সমিতি নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তত্ত্বাবধানে স্বনির্ভর হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন ওই মহিলা। সংখ্যালঘু বিত্ত নিগম ব্যবসার জন্য ঋণ দেয় তাঁকে। তা দিয়ে একটি মুদির দোকান চালাতে চান তিনি।
অন্য তরুণী ক্যানিং ১-এর বাসিন্দা। একদিন অজানা একটি নম্বর থেকে তাঁর কাছে ফোন আসে। পাত্তা দেননি। বারবার একই নম্বর থেকে ফোন আসতে থাকায় একদিন নিজেই সেই নম্বরে ফোন করেন। অপর প্রান্ত থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে ফিরিয়ে দেননি তরুণী। ভ্যানচালক বাবার একার রোজগারে সংসার চলে। নিদারুণ অভাব। দিল্লি গিয়ে নতুন সংসার পাতার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে দিল্লি চলে যান। কয়েকদিনের মধ্যে তাঁকে একটি হোটেলে বিক্রি করে দেয় তাঁর প্রেমিক। তারপর থেকে ওই হোটেলের ঘরে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করাটাই তাঁর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে তাঁর পরিবার স্থানীয় থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করে। একদিন হোটেল থেকে একটি ফোন জোগাড় করে বাড়িতে যোগাযোগ করেন তিনি। তারপর পুলিশি হস্তক্ষেপে আগ্রার হোটেল থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁকে। তিনিও সংখ্যালঘু বিত্ত নিগমের কাছ থেকে ঋণ পেয়ে একটি মনোহারি দোকান সাজিয়েছেন ক্যানিং এলাকায়। যে দুই ব্যক্তি এই দুই মহিলাকে বিপথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের খোঁজ করছে পুলিশ। আর বিত্ত নিগমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে যাঁরা আবেদন করবেন, সেই সব দুঃস্থ মহিলার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে নিগম।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.