হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষিকা ও তাঁর মা৷
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: কেউ বলছেন অশরীরী, কেউ বলছেন জঙ্গি ঢুকেছে এলাকায়। বাড়ি থেকে মহিলা, শিশুদের নাকি তুলে নিয়ে যাচ্ছে অশরীরী,জঙ্গিরা। কোথাও মহিলাদের উপর চালাচ্ছে পাশবিক অত্যাচার, ডাকাতিও করছে। কেউ আবার ফেসবুকে লিখছেন, ‘যারা এই দুষ্কর্ম করছে, তাদের চোখে দেখা যাচ্ছে না। তারা অশরীরী। তাই পুলিশও তাদের ধরতে পারবে না।’
গত কয়েকদিন ধরেই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে এই গুজব ছড়াচ্ছে। যার জেরে ঘুম ছুটেছে পুলিশ-প্রশাসনের। গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন জেলায় গুজবের কারণে একের পর এক মানুষ জনরোষের শিকার হচ্ছেন৷ উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মালদহ, বর্ধমান-সহ অন্যান্য জেলায় দাবানলের মতো গুজব ছড়িয়েছে যে, এলাকায় নাকি দুষ্কৃতীরা দল বেঁধে ঢুকেছে এবং রাতের অন্ধকারে হামলা চালাচ্ছে৷ কোথাও ডাকাত, কোথাও ছেলেধরা, কোথাও বোরখা পরা চোর, কোথাও আবার জঙ্গি, অশরীরী। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চায়ের দোকানে, রং চড়িয়ে বেড়ে চলেছে এই গুজব৷ যে কারণে এলাকায় অচেনা লোক দেখলেই অত্যুৎসাহীরা ধরে গণপিটুনি দিতে শুরু করছে৷
এলাকায় নতুন কাউকে ঢুকতে দেখলেই তেড়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা। করছেন রাত পাহারার ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষকে এই ধরনের গুজব ছড়াতে নিষেধ করেছে পুলিশ। মানা করা হয়েছে, এই ভ্রান্ত গুজবে কান দিতেও। এ বিষয়ে খড়দহ থানা ও ব্যারাকপুর কমিশনারেটের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানো হয়েছে, ‘সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে কয়েকটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভিনগ্রহের জীব, জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা নাকি ঢুকে পড়েছে কোথাও কোথাও। এ ধরনের গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দেবেন না।’
এই গুজবের জেরেই হুগলির বলাগড়ে শিক্ষিকা অপর্ণা ঘোষ ও তাঁর মাকে গণপিটুনি দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি অংশ। ঘটনায় এগারোজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ৷ ঘটনায় যুক্ত বাকিদেরও খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ৷ গত শনিবার রাতে এই গণধোলাইয়ের সময় স্থানীয় বিধায়ক অসীম মাঝিকেও হেনস্তা করা হয়৷ তাঁকে ঘিরে অশ্লীল গালিগালাজ দেয় কিছু যুবক৷ তাদেরও খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ৷ শিক্ষিকা ও তাঁর মা যে গাড়িটিতে ছিলেন সেটি কেরোসিন তেল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে৷ বেধড়ক মারধরে গুরুতর আহত ওই শিক্ষিকা ও তাঁর মাকে নদিয়ার কল্যাণীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ শনিবার রাতে এই ঘটনার পর অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে৷
স্থানীয় সূত্রে খবর, শিক্ষিকা অপর্ণা ঘোষ ও তাঁর মা অঞ্জুবালা ঘোষের বাড়ি নদীয়ার কল্যাণীর ডি ব্লকে৷ তাঁদের পরিচারিকার বাড়ি বলাগড়ের জিরাটে৷ শনিবার রাতে ওই শিক্ষিকা ও তাঁর মা নিজেদের গাড়ি করে পরিচারিকার বাড়িতে দেখা করতে যান৷ আসনপুরের কাছে পাড়ার ছেলেদের ওই পরিচারিকার বাড়ির খোঁজ করতেই মুহূর্তের মধ্যে রটে যায় ছেলেধরা ঢুকেছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই গুজবের জেরে কয়েকশো জনতা হাজির হয়৷ উন্মত্তের মতো তারা শিক্ষিকার গাড়ির উপর চড়াও হয়৷ গাড়ির চালককে বেধড়ক মারধরের পর শিক্ষিকা ও তাঁর মায়ের উপর চড়াও হয়৷ বেধড়ক মারধর করা হয়৷ এই ঘটনায় বাধা দিতে এসে তিরবিদ্ধ হন এক সিভিক ভলাণ্টিয়ার৷ গণপিটুনির খবর পেয়ে স্থানীয় বিধায়ক অসীম মাঝি পৌঁছলে তাঁকেও ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখানো হয়৷ অশ্লীল গালিগালাজ করা হয় তাঁকে৷ খবর পেয়ে বিশাল পুলিশবাহিনী ঘটনাস্থলে হাজির হয়৷ মারমুখী জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষিকা ও তাঁর মাকে উদ্ধার করে৷ কিন্তু উত্তেজিত জনতা আচমকা শিক্ষিকার গাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়৷ এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ মাইকে দিনভর প্রচার চালিয়েছে৷
পুলিশের একটি অংশের অভিমত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছেলেধরার গুজব রটিয়ে এমন ঘটনা ঘটানো হচ্ছে৷ একই অভিমত স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বেরও৷ বলাগড় ব্লক তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ রায় বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীন গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে ছেলেধরা ও মাওবাদী গুজব ছড়ানো হচ্ছে৷ পুলিশ কোনও সমাজবিরোধীকে ধরলে রটানো হচ্ছে মাওবাদী ধরা পড়েছে৷ তাঁদের অভিযোগ, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে৷ স্থানীয় কিছু সমাজবিরোধী এই সুযোগে এলাকায় উত্তেজনা ছড়াছে৷ বলাগড়কে অশান্ত করার চেষ্টা চালাছে৷
গুজবের জেরেই শুক্রবার বর্ধমানের কালনা শহরের বারুইপাড়ায় গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় রানাঘাটের হবিবপুরের রাঘবপুর গ্রামের বাসিন্দা অনিল বিশ্বাসের৷ জানা যায়, আমগাছে কীটনাশক স্প্রে করার কাজে গিয়েছিলেন তিনি৷ অনিলবাবুর পাঁচ সঙ্গীকেও ব্যাপক মারধর করা হয়৷ ঘটনায় দোষীদের ফাঁসির দাবি তুলেছে মৃতের পরিবার৷ এই ঘটনায় আহত চারজন এখনও আশঙ্কাজনকভাবে ভর্তি হাসপাতালে৷ ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি হবিবপুরের রাঘবপুর গ্রামের মানুষ৷ স্রেফ সন্দেহের বশে নিরীহ পাঁচজন গ্রামবাসীকে গণপিটুনি দেওয়ার ভয়াবহতায় স্তম্ভিত সবাই৷ রবিবার মৃতের পরিবার-সহ আহত সমীর দাস, ব্যঞ্জন বিশ্বাস, মধু মজুমদার ও মানিক সরকারের পরিবার এই ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসির দাবি তুলেছেন৷ মৃত অনিল বিশ্বাসের ভাইপো সন্দীপ বিশ্বাস এদিন কঠোরতম শাস্তির দাবি তুলে বলেন, “মানুষ হয়ে যারা নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে তাদের ক্ষমা করা যায় না৷ আমরা চাই তাদের ফাঁসি হোক৷ বন্ধ হোক গুজব ছড়ানো৷”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.