সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ১৭৭৩ সালে পাঁচেট। ১৮০৫ সালে পাঁচেট জেলা ভেঙে জঙ্গলমহল। এরপর ১৮৩৩–এ আবার জঙ্গলমহল ভেঙে মানভূম। সেই মানভূমকেই ১৯০৫–এ লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সময় বিহার–ওড়িশার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মাতৃভাষা বাংলার অধিকার রক্ষায় সেই সাবেক মানভূম ভেঙে জন্ম হয় পুরুলিয়ার। পাঁচেট থেকে পুরুলিয়া। ১৭৭৩ থেকে ১৯৫৬। ছোটনাগপুর মালভূমির এই বিস্তীর্ণ এলাকাকে বারেবারে ভেঙে টুকরো করা হয়েছে। তাই আর ভাগ চায় না ছোটনাগপুর মালভূমির পুরুলিয়া (Purulia), বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের মূলবাসী–আদিবাসীরা।
বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁর (Soumitra Khan) ‘জঙ্গলমহল ভাগে’র ইঙ্গিতের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বনমহলের মানুষজন। তবে সেই সঙ্গে বাম জমানায় সেই পুরনো দাবি বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন যেন আবার নতুন করে সামনে চলে এল! অভিযোগ, সেই দাবিকে কার্যত উসকে দিলেন বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁই। তবে ওই সাংসদের বক্তব্য যে বিজেপি নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নয়, তা আগেই জানিয়েছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষ। রবিবার এই বিষয়ে মুখ খোলেন বিজেপির এসটি মোর্চার সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা দক্ষিণ বাঁকুড়ার বাসিন্দা ক্ষুদিরাম টুডু। তিনি বলেন, “এটা আমাদের দলের সিদ্ধান্ত নয়। ওই সাংসদের ব্যক্তিগত মতামত। তবে জঙ্গলমহল আজও উপেক্ষিত, বঞ্চিত।” সৌমিত্র খাঁর মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতেই দলের তরফেও তাঁকে সতর্ক করা হয়। দলীয় বৈঠকেও তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হয়। শেষমেশ চাপের মুখে সাফাই দেন বিজেপি সাংসদ। বলেন, “রাড়বঙ্গের দাবি ব্যক্তিগত। এর সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই।”
কিন্তু জঙ্গলমহলের সাধারণ আদিবাসী–মূলবাসীরা কী চান? তাঁদের বিপুল সমর্থনেই জঙ্গলমহল তৃণমূলের ‘সবুজ গড়’। তাই বাংলার প্রাণভোমরা জঙ্গলমহলকে আলাদা করা হোক, তা মেনে নেবেন না এখানকার আমজনতা। দামোদর, অজয় ছুঁয়ে সুবর্ণরেখার তীরবর্তী এই ভূমি জঙ্গলমহল ভাগের তীব্র বিরোধী। সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী লোকশিল্পী সংঘের রাজ্যের সহ–সম্পাদক, লোকসংস্কৃতি গবেষক জলধর কর্মকার বলেন, “জঙ্গলমহল ভাগ হলে এখানকার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জাতিসত্ত্বা, এমনকী ইতিহাস নষ্ট হয়ে যাবে। ‘নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যাবে।’ তাই এই ভাগ কোনওভাবেই হতে দেওয়া যাবে না।”
গঙ্গার এপার–ওপারের সংস্কৃতি আলাদা হলেও সেই সঙ্গে কিছু বিষয়ে মিল না থাকলেও জঙ্গলমহল ভাগের বিরোধীতায় সরব বনমহল। রাজ্যের বন বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী, ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা বিরবাহা হাঁসদা বলেন, “জঙ্গলমহল বাংলাকে সমৃদ্ধ করে। সেই জঙ্গলমহলকে আলাদা এখানকার মানুষ মেনে নেবেন না।” তবে এই জঙ্গলমহলে ঝাড়খণ্ডী দলগুলি দীর্ঘদিন ধরেই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, তৎকালীন পশ্চিম মেদিনীপুরকে নিয়ে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। যাতে শহিদও হয়েছেন অনেকে। সেই আন্দোলনের অন্যতম নেতা, বর্তমানে আদিবাসী কুড়মি সমাজের মূল মানতা অজিতপ্রসাদ মাহাতো বলেন, “এখন আমি আর ওই আন্দোলনে যুক্ত নই। কিন্তু আমি চাই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর (Medinipur) নিয়ে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন হোক।”
এই মালভূমির সাবেক মানভূম-সহ সমগ্র বাঁকুড়া ও বর্ধমানের একটা অংশ ছিল অতীতের পাঁচেট জেলায়। তার সদর শহর ছিল বর্তমানে পুরুলিয়ার শিল্পশহর রঘুনাথপুর। বিট্রিশরা পাঁচেট ভেঙে জঙ্গলমহল জেলা গঠন করেন। যার সদর কার্যালয় ছিল বাঁকুড়া। সেই জঙ্গলমহল ভেঙে মানভূম। একসময় যার সদর শহর ছিল মানবাজার। পরে হয় পুরুলিয়া।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.