পলাশ পাত্র ও টিটুন মল্লিক: অসমে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯ লক্ষ নাম বাদ পড়েছে। বাংলাতেও এনআরসি হবে বলে একাধিকবার জানানো হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। ফলে আতঙ্ক বেড়েছে এরাজ্যের সীমান্ত লাগোয়া বাসিন্দাদের। এনআরসি’র জুজুতে রাত থেকে আধার কার্ডের সংশোধনীর জন্য সীমান্ত জেলা নদিয়ায় ব্যাংক, পোস্ট অফিসের সামনে লম্বা লাইন। গ্রাম, মফস্বল থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরের আধার সেন্টারগুলি সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বিপাকে।
প্রয়োজনের তুলনায় আধার সেন্টারের সংখ্যা কম হওয়া নিয়ে অসন্তুষ্ট অনেকেই। হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত এলাকা করিমপুর থেকে কল্যাণী পর্যন্ত ছুটে এসেছেন আধার কেন্দ্রগুলিতে। রাত থেকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েও কাজ না হওয়ায় ফের ব্যাপক সমস্যার মুখে তাঁরা। একইসঙ্গে বিড়ম্বনা বেড়েছে শহরের বাসিন্দাদেরও। কারণ, বাড়িগুলির আশেপাশেই এই আধার কেন্দ্র। আর সেখানে ভিড়ের চাপ বাড়ায়, প্রভাব পড়ছে এই বাড়িগুলিতেও। বাসিন্দাদের বক্তব্য, রাতবিরেতে যত্রতত্র নোংরা বাড়ির সামনে ফেলে রাখা হচ্ছে। বাড়িতে উঁকি মারা হচ্ছে। চুরি, ডাকাতি নিয়েও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা।
শুধু সীমান্ত করিমপুর, তেহট্ট, চাপড়া নয়, কিংবা পলাশিপাড়া, কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া ব্লকেই নয়, কৃষ্ণনগরেও এই সমস্যা হয়েছে। কৃষ্ণনগর হেড পোস্ট অফিস সংরক্ষিত অঞ্চল হলেও, আধার সংশোধন করতে আসা পুরুষ, মহিলারা তার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন। এসব লাইনের মাঝে দালালরাজও সক্রিয়। মঙ্গলবার রাতে হাতেনাতে ধরে ফেলার পরও এক দালাল নাগাল থেকে পালিয়েছেন। পোস্টমাস্টার নিজেই অভিযোগ করছেন, একদল লোক টাকার বিনিময়ে সব কাজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘দালাল ধরা তো আমাদের কাজ নয়। ভিতরে লোকজন চলে আসছে, অপরিষ্কার করছে। আমরা পুলিশকে এখানে পাহারা দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আসেননি।’ করিমপুরে কর্মীর অভাবে গত তিনদিন ধরে স্টেট ব্যাংকে আধার সংশোধনীর কাজ বন্ধ রয়েছে। স্বভাবতই তেহট্ট, বেতাইয়ে এসবিআইয়ের আধার সেন্টারে বাড়তি চাপ পড়েছে। পলাশিপাড়াতেও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নদিয়ায় করিমপুর, তেহট্ট, বেতাই, পলাশিপাড়া, পলাশি, বেথুয়াডহরি, কৃষ্ণনগরের স্টেট ব্যাংকের শাখায় আধার কেন্দ্র হয়েছে। ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার নবদ্বীপ, রানাঘাট, চাকদহ, কৃষ্ণনগর ও জাগুলিতে এই কেন্দ্র রয়েছে। কুড়ি থেকে পঁচিশটি কেন্দ্রে আধার সংশোধনীর কাজ হচ্ছে। যা প্রয়োজনের তুলনাই খুবই কম। এই অবস্থায় সেন্টারের সংখ্যা না বাড়ালে যে কোনও সময় বড় ধরনের গণ্ডগোল বেঁধে যেতে পারে বলে জানাচ্ছেন লাইনে দাঁড়ানো ইব্রাহিম সেখ, বিমল বিশ্বাসরা। নিরাপত্তা থেকে দালালরাজের সক্রিয়তা, এনআরসি’র আতঙ্কের মধ্যে নতুন করে জুড়ে বসেছে এই ভয়।
আধার কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো প্রসঙ্গে জেলাশাসক পীযূষ গোয়েল বলেন, ‘বিষয়টি ব্যাংককেই করতে হবে। তবে ওনারা আমাকে কাজের এখনও কোন তালিকা দেননি। কর্মী সংকট আছে। কাজটা ধীরে হচ্ছে। সময় লাগবে।’ স্টেট ব্যাংকের রিজিওনাল ম্যানেজার পিনাকী মুখোপাধ্যায় বা ইউবিআই-এর ম্যানেজার বিমল ভট্টাচার্যদের কথায়, ‘উইআইডিআইয়ের লোকজন কাজ করছেন। সরকারের নির্দেশ যেমন আসে, আমরা সেইমতো তা পালন করি। তাই এ নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’
একই পরিস্থিতি বাঁকুড়া জেলাতেও। আচমকা ভিটেমাটি হারানোর আতঙ্ক চেপে ধরেছে প্রান্তিক মানুষগুলোকে। তাই দ্রুত আধার কার্ড সংশোধন করাতে বাঁকুড়ার বিডিও কার্যালয় ও ডাকঘরের সামনে হাজারও মানুষের ভিড়। আশঙ্কার বহর এতটাই যে মাঠের মধ্যে চাদর বিছিয়ে পরিবারের সঙ্গে রাত জাগছেন মহিলারাও। বাঁকুড়ার ডাকঘরে গত শনিবার থেকে লাইন দিয়েছেন পুনিশোলের ইমারুল মোল্লা। তিনি বলছেন, ‘বৃষ্টি হোক, রোদ্দুর হোক – আধার কার্ড সংশোধন করাতেই হবে। জানেন, বাড়ি ছেড়ে গত চারদিন ধরে এই জন্য হোটেলে পড়ে আছি। একেবারে কাজ শেষ করিয়ে ফিরব।’ বড়জোড়ার মানাচর থেকে আধার কার্ড সংশোধন করতে এসেছেন শম্পা কৈবর্ত্য।সপ্তাহ দুয়েক ধরে এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে তিতিবিরক্ত তিনি। বলছেন, ‘কী আর করব? আধার কার্ড সংশোধন না হলে ভিটে ছাড়া হতে হবে, চলেই যাব!’
কবে এনআরসি চালু হবে বাংলায়, আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সরকারিভাবে কোনও ঘোষণাই নেই। তা সত্ত্বেও না হলেও ভয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছেন বাঁকুড়াবাসীর একটা বড় অংশ। ভয় যে তাঁদের কতখানি গ্রাস করেছে, তা জেলার বিভিন্ন ডাকঘর, ভূমি সংস্কার দপ্তর, খাদ্য দপ্তর ও বিডিও কার্যালয়ের সামনে ভিড়ই প্রমাণ করে। বিডিও অফিসে ডিজিটাল রেশন কার্ড সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। ভিড় করছেন প্রচুর মানুষ। চলছে ছোটখাটো বচসা, ধাক্কাধাক্কি।বাধ্য হয়ে পুলিশ প্রচার করছে, কোনওরকম গুজবে কান দেবেন না। এখানে স্রেফ রেশন কার্ড সংশোধন হচ্ছে।
বাঁকুড়ার সরকারি আধিকারিকরা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই জেলার বিভিন্ন ব্লকের মানুষ তাঁদের আধার কার্ড, রেশন কার্ড, পুরনো দিনের জমির কাগজপত্র জোগাড় করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির সামনে রাত থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। সমস্ত বাসিন্দাদের অভিযোগ একটাই। গুটিকয়েক ডাকঘরে আধার কার্ড সংশোধনের কাজ চলছে। ফলে দীর্ঘ সময় লাগছে। জেলা খাদ্য সরবরাহ দপ্তর সূত্রে খবর, গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে রাজ্য জুড়ে নতুন রেশন কার্ড, রেশন কার্ডের সংশোধনের জন্য আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে। ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই আবেদন নেওয়া হবে। জানা গিয়েছে, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। শুধুমাত্র রেশন কার্ডের নাম-ঠিকানা সংশোধনের জন্য (৫ নম্বর ফর্ম) আবেদনও জমা পড়েছে প্রায় ৬৫ হাজার। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরেও ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সূত্রের খবর, শুধুমাত্র বাঁকুড়া শহরে ১৯৬০ সালের আরএস রেকর্ড পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন শতাধিক মানুষ। স্বাধীনতার আগে জমি বণ্টন করে দিতে এই আরএস রেকর্ড চালু করেন ব্রিটিশরা। পরবর্তী সময়ে বাংলায় বাম সরকার তা খারিজ করে সিআর রেকর্ডের মাধ্যমে জমি বণ্টন করেছিল। তাতে জমির মালিকানা পেয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগতরাও। এখন এনআরসি চালু হলে, সিআর রেকর্ড নয়, আরএস রেকর্ডই গণ্য হবে। তাই জেলার প্রায় প্রতি ব্লকেই আরএস রেকর্ডের জন্য রোজই নতুন করে আবেদন জমা পড়ছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.