সৌম্য মুখোপাধ্যায়: বাঙালির বারো মাসে তেরোপার্ব্বণের কথা আজ সবাই জানে। কিন্তু, সমস্ত মেলা ও উৎসবের মাঝে হুগলি জেলার আদি সপ্তগ্রামের মাছের মেলা মনে হয় সব থেকে অভিনব। ‘মৎস্য ধরিব, খাইব সুখে’ স্লোগানটা কিছুটা বদলে এখানে হয়ে গিয়েছে ‘মৎস্য কিনিব আর খাইব সুখে’।
অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান দেবানন্দপুর থেকে খুব কাছেই অবস্থিত কৃষ্ণপুর বা কেষ্টপুর গ্রাম। জিটি রোড ধরে আদি সপ্তগ্রাম থেকে দেবানন্দপুর মোড়ে পৌঁছতে পারলেই কেষ্টপুর যাওয়ার লালমাটির অপ্রশস্ত রাস্তা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে অটো বা টোটোতে করে ১৫ থেকে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন কেষ্টপুর মোড়। সেখান থেকে ৫০০ মিটার হাঁটলেই রঘুনাথ দাস গোস্বামীর সাধনভূমি শ্রীপাট, ৫০০ বছর ধরে বৈষ্ণবদের মহান মিলনক্ষেত্র বলে পরিচিত।
৫১৩ বছর আগে কেষ্টপুরের রাজকুমার রঘুনাথ দাস গোস্বামী সন্ন্যাস গ্রহণের পর পয়লা মাঘ বাড়ি ফিরেছিলেন। সঙ্গে আনা কৃষ্ণের মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার সঙ্গেই জড়িয়ে মেলার ইতিহাস। কেষ্টপুর এলাকাটি ছিল সপ্তগ্রামের রাজা হিরণ্যদাস ও তাঁর ভাই গোবর্ধন মজুমদারের অধীনস্ত এলাকা। গোবর্ধনের ছেলে রঘুনাথ ছোটবেলা থেকে ধর্ম অন্ত প্রাণ ছিল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পায়ে হেঁটে চলে যান ওড়িশার মন্দির শহর পুরী। সেখানেই নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ পান তিনি। এরপর কেষ্টপুরে ফিরে পয়লা মাঘ মহাপ্রভুর দেওয়া কৃষ্ণমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকেই প্রতিবছর একই দিনে বসছে আসছে এই মেলা। বৃহস্পতিবার পাঁচ শতক পুরনো এই অভিনব মেলায় বিভিন্ন মাছের পসরা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রায় ৭০ জন মৎস্যজীবী।
কিন্তু, বৈষ্ণবদের মেলার সঙ্গে মাছ এল কীভাবে? এই নিয়ে দুটি গল্পও আছে। তার একটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পরম বৈষ্ণব রঘুনাথ দাসের খ্যাতি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে তাঁর ভক্তির পরীক্ষা নিতে তৎকালীন শ্রীপাট নামে খ্যাত ওই এলাকায় মাঘ মাসের প্রথম দিন হাজির হয়েছিলেন ৭০০ জন বৈষ্ণব। অসময়ে আবদার করেছিলেন ইলিশ মাছের ঝোল আর আমের টক দিয়ে ভাত খাবেন বলে। কৃষ্ণের পরম ভক্ত রঘুনাথের প্রার্থনায় সরস্বতী নদীর ধারে থাকা রাজবাড়ির পুকুরে ধরা পড়েছিল জোড়া ইলিশ। মাঘের শীতে বাগানের গাছেও মিলেছিল আমের দেখা। রঘুনাথের ভক্তির এত শক্তি হতবাক হয়েছিলেন সবাই। আর সেই সেই ভক্তির জোরেই এই ঘোর কলিতে আজও জোরকদমে চলে আসছে এই মাছের মেলা।
অন্য মতের অনুসারীরা আবার বলেন অন্য গল্প। তাঁদের কথায়, কিশোর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণের পর দীর্ঘদিন বাদে এই পয়লা মাঘই বাড়ি ফিরেছিলেন রঘুনাথ। সেই আনন্দের এলাকার সমস্ত মানুষ বিভিন্ন জিনিসপত্রের সঙ্গে প্রচুর মাছও নিয়ে এসেছিলেন উপহার হিসেবে। সেই স্মৃতিকে মাথায় রেখে প্রতিবছর পয়লা মাঘ সকাল থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত একদিনের এই মেলা হয়।
মৎস্যজীবী, মৎস্যপ্রেমী আর মৎস্যলোভীদের এমন জমজমাট জমায়েতের উদাহরণ বাংলা কেন ভূ-ভারতে কোথাও পাওয়া যাবে না। ভিতরে মন্দিরে যখন নামসংকীর্তনে বিভোর বৈষ্ণব সাধক তখন মন্দিরের পাশেই দর কষাকষিতে ব্যস্ত মৎস্য বিক্রেতা ও ক্রেতাকুল। প্লাস্টিকের চাদর বিছিয়ে বসে পড়েছেন মাছ বিক্রেতারা। পেল্লাই বটিতে অতিকায় মাছের ধড়-মুণ্ড আলাদা হচ্ছে নিমেষে।
কি নেই সেখানে! ২০ থেকে ৩০ কিলোর ভেটকি কিংবা ১৫০ কিলোর শংকর মাছ। অথবা ৩০ কিলোর সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প থেকে শুরু করে নাইলন টিকা, হালুয়া, ভেটকি, ভোলা, মাগুর, চিংড়ি, কালবোস, মৌরলা ও পুঁটির চেনা ভিড়ে বেশ নজর কাড়বে এক ও দু দাঁড়ার সামুদ্রিক কাঁকড়াও। সমুদ্র, নদী ও বাংলার খালবিলের অচেনা অনেক প্রজাতির মাছই আপনাকে চমকে দেবে। রূপচাঁদা থেকে কাঁচকি আর বাঁশপাতা, খলসে, ফাসা, ন্যাদোস আপনাকে মনে করিয়ে দেবে নদীমাতৃক বাংলার সেইসব হারিয়ে যাওয়া মাছেদের কথা।
মেলা থেকে মাছ কিনে অনেকেই কৃষ্ণপুরের আমবাগানে বা কলাবাগানে হাজির হন।উদ্দেশ্য জমিয়ে মৎস্য সহযোগে মহাভোজ। প্রথমতঃ মাছ, দ্বিতীয়ত মাছ এবং শেষ পর্যন্ত মাছের এই মেলাকে সার্থক করতে এলাকার বাড়িতে বাড়িতে অতিথিদের ভিড়। মাছ কেনার পাশাপাশি নানা ধরনের মাছ দেখার সুবর্ণ সুযোগ কি আর সবসময় পাওয়া যায়?
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.