টিটু মল্লিক, বাঁকুড়া: মুড়ি খাওয়ায় বাঁকুড়াবাসীর সুনাম দীর্ঘদিনের। সেই মুড়িকে ঘিরে আস্ত একটা মেলা! মুড়ির উপর বাঁকুড়াবাসীর প্রীতি টের পেতে হাজির হতেই হবে বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়ায় দ্বারকেশ্বর নদের চরে। ফি বছর ৪ মাঘ শীতের শিরশিরানির গায়ে মেখে এই মেলায় হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। শুধুমাত্র সকালের মিঠে রোদ পিঠে মেখে মুড়ি খেতেই এই নদের চরে ভিড় জমান তাঁরা। পৌষ সংক্রান্তির পিঠে পরবের রেশ কাটতে না কাটতেই রোজকার ডায়েট, ফিটনেস রেজলিউশন ভুলে টম্যাটো, শশা, গাজর, মটরশুঁটি, বিট মাখিয়ে নদের চরে পেপার পেতে বন্ধুবান্ধব, পরিবার পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে মুড়ি খাওয়ায় আয়োজন দেখলেই টের পাওয়া যায় এই মুড়ি মেলার আমেজ। শীতের মরশুমি আনাজের সঙ্গে থাকে সাধ্যানুযায়ী নানা ধরনের চপ, সিঙাড়া, লঙ্কা, পেঁয়াজ, চানাচুর, নারকেলের মিশ্রণ। সঙ্গে ওই মুড়ির পাতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে লাল লঙ্কার ঝাল চাটনি। দ্বারকেশ্বর নদের পাড়ে জাঁকিয়ে বসে হাজার হাজার মানুষের প্রাতরাশ করার হুজুগ-ই মেলার আকার নিয়েছে।
গ্রামীণ এই মুড়ি মেলার টানে দ্বারকেশ্বর নদের ধার বরাবর ছোট-বড় দোকানগুলির কড়াইয়ে টগবগিয়ে ফুটছে আলু-মটরের ঘুগনি। কোথাও গরম তেলে ভাজা হচ্ছে বাদাম, পাপড়। উনুনে বসানো চায়ের কেতলির মুখ থেকে গল গল করে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। এ সবের গন্ধে ভরপুর গোটা মেলা চত্বর। মেলায় আসা তরুণী রেশমা সরকার বলেন, মাঘের সকালে শিরশিরে হাওয়া গায়ে নিয়ে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মুড়ি দিয়ে প্রাতরাশ সারাই মজাই আলাদা। তারপর টুক করে প্রাচীন রহস্যের খোঁজে ঢুকে পড়ি পাশের সঞ্জীবনী আশ্রমে। একই বক্তব্য রানিগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক ষাটোর্দ্ধ রমা তেওয়ারির।
বাঁকুড়া শহর লাগোয়া কেঞ্জাকুড়া গ্রামের কাছে দ্বারকেশ্বর নদের পাড়ে রয়েছে সঞ্জীবনী আশ্রম। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এই আশ্রমে বহু প্রাচীন কাল থেকে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে হরিনাম সংকীর্তন হয়ে আসছে। এই হরিনাম চলে মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে। স্থানীয়রা বলেন, এক সময় ওই এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা হরিনাম শুনতে আসতেন ওই আশ্রমে। হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণের ভয়ে রাতে তাঁরা নিজেদের গ্রামে ফিরতে পারতেন না। সারারাত জেগে নামগান শুনে পরের দিন সকালে দ্বারকেশ্বরের জলে নিজেদের সঙ্গে থাকা মুড়ি ভিজিয়ে খেয়ে বাড়ি ফিরতেন।
ভক্তদের সেই মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজে পরিণত হয়েছে উৎসবে। এখন সকলেই বাড়ি থেকে সঙ্গে করে পাহাড় প্রমাণ মুড়ি নিয়ে এসে বছরের এই দিনটি ওই নদের চরে ভিড় জমান। পিকনিকের আমেজে বসে মুড়ি মেলা। দিনভর চলে মুড়ি খাওয়া। ওই মুড়ি মেলাকে ঘিরে গত কয়েক দশক ধরে বসছে নানা পণ্যের পসরা। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে মুড়ি মেলার এই দিনটিকে উৎসবের রূপ দিয়েছে। রমরমিয়ে চলে বিক্রিবাটা। এই মুড়ি মেলার উদ্যোক্তা বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, মরশুমি আনাজের ছোট ছোট কুচি, চপ আর ঝাল আচারের স্বাদে মুড়ি খাওয়ার আমেজটাই আলাদা। প্রাচীন এই দ্বারকেশ্বর নদের পাড়ে থাকা আশ্রমের পুরনো স্মৃতি উসকে দিতেই এই মুড়ি মেলার আয়োজন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.