কল্যাণ চন্দ্র, বহরমপুর: লম্বা সিঁড়ি। বাবার কোলে চেপেই সেই সিঁড়িতে ওঠা-নামা করে ক্লাস করতে হয়েছে কলেজে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ি ভেঙে পরীক্ষা হলে। উপায় নেই। দুরারোগ্য রোগে জন্মের পর থেকে দু’টি পা অকেজো। বাবার কোলে চেপে পেরিয়েছেন স্কুল-কলেজ। মফস্বলের চৌকাঠ ডিঙিয়ে এবার তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা হলে। প্রতিকূলতার কাছে হার মানতে নারাজ তিনি।
রবিউল ইসলাম। ৮০ শতাংশ ওই প্রতিবন্ধী ছাত্র বর্তমানে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এমএ পরীক্ষা দিচ্ছেন। প্রতিদিন বাবার কোলে করেই ডোমকল থেকে বহরমপুরের মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় আসছেন রবিউল। আদর্শ শিক্ষক হয়ে সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন রবিউলের চোখে মুখে। ডোমকল থানার শিবনগর গ্রামের লুৎফুর রহমান পেশায় খেতমজুর। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে রবিউল ইসলাম পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় জ্বরে কাবু হওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা হয় তার। সুস্থ হয়ে উঠলেও ধীরে ধীরে দুটি পা শুকিয়ে যায় রবিউলের। হাঁটাচলার শক্তি না থাকলেও মনের অদম্য জোর নিয়ে ভগীরথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে সব বিষয়ে ভাল নম্বর পাওয়ার পর ডোমকল কলেজে ভর্তি হন রবিউল। কলেজ টপটে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে। রবিউলের বাবা লুৎফর রহমান বলেন, “ডোমকল কলেজে দোতলায় ক্লাস করার সময় কোলে তুলে নিয়ে যেতে হত ছেলেকে। তাঁর স্ত্রী নাসরিনবানু বিবি ওই উচ্চ বিদ্যালয় মিড ডে মিলের রান্না করেন। সেই সুবাদে তিনিও রবিউলকে কলেজে নিয়ে যেতেন মাঝেমধ্যে। ৭১ শতাংশ নম্বর পেয়ে ইতিহাসে অনার্স পাশ করেছেন রবিউল।”
এরপর তাঁকে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করা হয়। গত চার মাস ক্লাস করার পর বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট সেমেস্টার পরীক্ষা দিচ্ছেন রবিউল ইসলাম। লুৎফুর রহমান জানান, ডোমকল কলেজের সিঁড়ি ভেঙে ছেলেকে কোলে করে নিয়ে যেতে হলেও মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা করতে হয় না। তবে প্রতিদিন ক্লাস করাতে রবিউলকে নিয়ে আসতে পারতেন না তিনি। তাঁর মতো খেতমজুরের পক্ষে একদিকে সংসার টানা এবং অপরদিকে প্রতিদিন মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস করতে নিয়ে যাওয়া হয় রবিউলকে। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যেমন সহযোগিতা পেয়েছেন, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছেন বলে কৃতজ্ঞ তিনি। লুৎফর রহমান বলেন, রবিউল যখন স্কুলে পড়ত তখন হুইল চেয়ার ছিল। কিন্তু ডোমকল থেকে বাসে করে বহরমপুর হুইলচেয়ারে নিয়ে আসা সম্ভব নয় ছেলেকে। সেই কারণে তিনি একটা তিনচাকার গাড়ির আবেদন করছেন। ছেলেকে সুশিক্ষিত করাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
এদিকে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে এক বছর ‘ডিএলএড’ করেছেন রবিউল। এদিন রবিউল বলেন, বাবার কোলে চড়ে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় আসতে নানা লোকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। লজ্জাও লাগে। তবে বন্ধু থেকে অধ্যাপকরা তাঁকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছেও তিনি কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতে শিক্ষক হয়ে গ্রামের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন রয়েছে তাঁর। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জানে আলম বলেন, রবিউল ইসলামের পরীক্ষার জন্য সব রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তি পূরণ হোক সেই কামনা করছেন তিনি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.