সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: চিত্র এক – ৭ জানুয়ারি, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা ৭.৩০। ঝাড়খণ্ডের চাণ্ডিল বনাঞ্চলের চৌকা থানার বাড়োদার একটি স্কুলের পাশ দিয়ে পার হয়ে যায় সে। ওই দিনই এক ঘন্টা পর – রাত ৮.৩০। চাণ্ডিলের বিখ্যাত গোলচক্কর থেকে ৫০০ মিটার দূরে। রুদিয়া-দড়দা রাস্তায় হলদে কালো ডোরাকাটার শরীরের উপর পড়ল গাড়ির হেডলাইটের আলো। চমকে গাড়িচালক ব্রেক কষতেই সেখান থেকে সরে যায় সে।
চিত্র দুই – ৮ই জানুয়ারি, বুধবার। সেই চাণ্ডিলের রাঁচি-জামশেদপুর জাতীয় সড়ক থেকে ২ কিমি দূরে নারগাডিহর পাশে রাত আটটার সময় আবার রাস্তায় চলে আসে সে। পিকআপ ভ্যানের চালক অরুণ কর্মকার চার চাকার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পান ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। পাওয়া যায় পায়ের ছাপও।
ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলা-খরসোওয়া জেলার চাণ্ডিল শহর লাগোয়া এলাকায় পরপর দুদিনের এই ঘটনাকে বনদপ্তর তালিকাভুক্ত করলেও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অবস্থানে আমল দেয়নি। নারগাডিহতে পাওয়া পায়ের ছাপকে বাঘের বলে সিলমোহর দেয়নি ঝাড়খণ্ড বনবিভাগ। তাহলে কি পরপর দুদিন ধরে স্রেফ গুজব? চাণ্ডিল বনাঞ্চলের আধিকারিক শশীরঞ্জন প্রকাশ বলেন, “বাঘের বিষয়টি আমরা গুজব বলব না। তবে গত দুদিনের তিনটি ঘটনায় স্থানীয় মানুষজন যে চিহ্নকে বাঘের পায়ের ছাপ বলছেন, তা কিন্তু নয়। বাঘের গলায় রেডিও কলার না থাকায় আমরা বাঘের সঠিক অবস্থান বুঝতে পারছি না। তবে আমাদের ধারণা, চাণ্ডিল বনাঞ্চলেই বাঘ রয়েছে।”
পরিস্থিতি যাই-ই হোক, চাণ্ডিল শহর একেবারে ‘বাঘ’ আতঙ্কে কাঁটা! দিনের বেলায় বাজার জমজমাট হলেও বুধবার থেকে সন্ধ্যা নামার আগেই যেন রাত নামছে পাহাড়ঘেরা চাণ্ডিল শহরে। গত শনি-রবিবার চাণ্ডিল ড্যামের পাশে তিন-চারটে পিকনিক পার্টি থাকলেও বৃহস্পতিবার থেকে আর ওই এলাকায় সেভাবে কোনও পিকনিক পার্টি দেখা যাচ্ছে না। অথচ ভরা শীতের মরশুম। উইকেন্ডেও এই সময় চাণ্ডিল জলাধার লাগোয়া এলাকার প্রতিদিনই পিকনিকের ভিড় থাকত। পুরুলিয়া থেকে বহু মানুষ পরিকল্পনা করতেন, চাণ্ডিল জলাধারের পাশে পিকনিক করার। কিন্তু এই ছোটনাগপুর মালভূমির পিকনিক স্পটের তালিকায় কার্যত বাদ চাণ্ডিল ড্যাম। শুধু পিকনিক পার্টি নয়, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষামূলক ভ্রমণেও পড়ুয়াদের ওই জলাধারে নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার থেকে সেই ছবি একেবারে উধাও। তবে বাঘের আতঙ্ক সেই ৩১ ডিসেম্বর থেকেই। তবে বুধবার থেকে সন্ধ্যাতেই যেন শুনশান হয়ে যাচ্ছে চাণ্ডিল শহর।
ওই রাতে পিকআপ ভ্যানের চালক অরুণ কর্মকার নারগাডিহ-চালকবেড়া রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময় রাঁচি-জামশেদপুর জাতীয় সড়ক থেকে ২ কিলোমিটার দূরে নারগাডিহ এলাকাতে সেই মঙ্গলবারের মতোই গাড়ির হেডলাইটে ডোরাকাটাকে দেখা যায় বলে দাবি। চালক অরুণ কর্মকারের কথায়, “আমি গাড়ি করে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎই শুনশান রাস্তায় বাঘ দেখতে পাই। ওই অবস্থায় কী করব, বুঝে উঠতে পারিনি। গাড়ি পিছনে করে দিই। তারপর আর কিছু দেখা যায়নি।”
এরপর ওই চালক এলাকার বাসিন্দাদের বললে বহু মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে যান। তিনি নিজে বনদপ্তরে খবর দেন। সঙ্গে সঙ্গে বনদপ্তর সেখানে যায়। কিন্তু তারা ওই ঘটনার আমল দেননি। কিন্তু ওই ঘটনার পর পার হয়ে গিয়েছে ২৪ ঘন্টা। কিন্তু এখনও ওই চালকের কাঁপুনি যায়নি। তাঁর কথায়, “দুদিন আগে নারগাডিহ গ্রামের পাশে আমার বাড়ির লোকজনও বাঘের গর্জন শুনেছিল।” এই ঘটনায় চাণ্ডিল শহর-সহ ছুঁয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রাম ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। চাণ্ডিলের গ্রামাঞ্চল এলাকায় সন্ধ্যাতেই দরজায় খিল দিচ্ছেন মানুষজন। এদিকে চাণ্ডিল ড্যাম লাগোয়া গাঙ্গুডি-পুনর্বাস এলাকার মানুষজন যাঁরা জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল, তাঁরা আর ওই জলধার সন্নিহিত জঙ্গলে যাচ্ছেন না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.