সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: রাজ্যজুড়ে যতই অশান্তির খবর আসুক না কেন, একেবারে অন্য মেজাজে ভোট হল পাহাড় ও জঙ্গলমহলে। কোথাও কোনও অশান্তির লেশমাত্র ছিল না। ছিল না ভোট লুট, ব্যালট ভাঙচুর কিংবা বন্দুকের নলের সামনে মাথা নত করে ভোট (Panchayat Poll) বয়কটের মতো বিষয়ও। বরং ভোট ঘিরে কার্যত উৎসবের মেজাজ ছিল দুই এলাকায়।
প্রায় দু’দশক পর পাহাড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে। কোথাও কোনও অশান্তি নেই। কারও কোনও হুমকি নেই। বাসিন্দারা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিচ্ছেন। সুকনা থেকে মিরিক, কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং, কালিম্পং সব জায়গায় একচিত্র। এদিকে আবার কিছু জায়গায় বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ভোট দিয়ে গেলেন বাসিন্দারা। আবার ভোট শেষে একসঙ্গে বসে দেদার আড্ডায় জমল। তারা আশাবাদী এবার তাদের দাবি পূরণ হবে। চুনাভাটির আশা তামাং বলেন, “পানীয় জলের অভাব রয়েছে। অনেকে এখনও বাড়িতে বিদ্যুৎ পায়নি। রাস্তা ভাঙা পড়ে রয়েছে। পঞ্চায়েত না থাকায় কাজগুলো হচ্ছিল না। এবার যেই জিতুক আমাদের দাবি পূরণ করে দিক।”
পাহাড়ে ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চাকে হারানোর জন্য বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সুপ্রিমো বিমল গুরুং, হামরো পার্টির সভাপতি অজয় এডওয়ার্ডকে নিয়ে একটি রামধনু জোট করেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন রণে ভঙ্গ দিয়ে দিল্লি চলে যান সাংসদ রাজু বিস্তা। আগেই বাবাকে চিকিৎসা করাতে হায়দরাবাদ চলে যান অজয় এডওয়ার্ড। অর্থাৎ নির্বাচনের দিন একা বিমল গুরুং নিজের গড় রক্ষা করলেন। সকালবেলা পাতলেবাসে নিজের ভোটদান করে সিংমারি দলীয় দপ্তরে চলে আসেন। সেখানেই তিনি বসে খবরাখবর নিতে থাকেন। অন্যদিকে অনীত থাপা কার্শিয়াং বসে থাকলেন। তিনি পাহাড়ের মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেওয়ার জন্য।
জঙ্গলমহলে গুলি, পোস্টার-বোমা, ল্যান্ডমাইন অতীত। নেই কোনও নাশকতা, হিংসা, বুথ দখল বা ছাপ্পাও। তাই এখানকার জনগন গণতন্ত্রের উৎসব পালন করে সকাল সকাল বুথের লাইনে দাঁড়িয়ে। যেমন করল শনিবার। এইবিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঝুট-ঝামেলা ছাড়া চাষাবাদের মরশুমেও একেবারে আড্ডার মেজাজে বুথের সামনে সব পক্ষ।
সেই জঙ্গলমহল। ঝাড়খন্ড ওড়িশার সীমানা ছুঁয়ে থাকা পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রাম। দক্ষিণ বাঁকুড়া থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের লালমাটি। যা একদা ছিল সিপিএম-র ‘লাল-গড়।’ যেখানে পঞ্চায়েত ভোটের নামে বুথ জ্যাম দেখতো এই বনমহল। সেখানেই এখন ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শান্তির ভোট। মহিলাদের নতুন কাপড়ে পরবের ভোট। ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা তথা রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্ত প্রকল্প বিভাগের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা বলেন, ” সমগ্র জঙ্গলমহলে উৎসবের চেহারায় ভোট হয়েছে। মানুষ একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বুথে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।”
ভরা বর্ষায় এই চাষাবাদের মরশুমেও একেবারে সাত সকাল থেকেই বুথে বুথে ছিল লম্বা লাইন। মহিলাদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। পুরুলিয়ার চাকলতোড়, বাঘমুন্ডি, বান্দোয়ান। অতীতের মাও উপদ্রুতের জন্য এই এলাকার স্পর্শকাতর বুথগুলিতে ইনসাস হাতে থাকা বিএসএফ জওয়ান বলেন, “ইলেকশন পিসফুল।”
ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি, লালগড়, জামবনি। সেই সঙ্গে দক্ষিণ বাঁকুড়ার বারিকুল। কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশকে নিয়ে সুষ্ঠু ভাবে ভোট হয়। পুরুলিয়ায় রাত দশটার পরেও বহু ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ছিল লম্বা লাইন।
অতীতে এই এলাকা ছিল মাও উপদ্রুত। তেমনই দক্ষিণ বাঁকুড়ার বারিকুল প্রাথমিক স্কুল, লালগড়ের ধরমপুর জুনিয়র হাই স্কুলের ৮৯ নম্বর বুথ, গোহমিডাঙার ৮৮ নম্বর বুথ অতীতে যেমন মাওবাদীদের ভোট বয়কটের হুমকিতে ভোটের হার কম হতো। তেমনই নয়ের দশকে এইসব এলাকায় পঞ্চায়েত ভোট মানে ছিল শুধুই সিপিএমের চোখরাঙানি। বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকায় বিরোধীরা প্রার্থীই দিতে পারত না। ঝাড়গ্রাম, শালবনি, লালগড়, বেলপাহাড়িতে লালপার্টি ছিল শেষ কথা। এখন শেষ কথা বলে জনগণ। এদিন তার হাতেকলমে প্রমাণ মিলল জঙ্গল মহলে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.