সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: শুকনো খটখটে রুখাশুখা পুরুলিয়া। খরা কবলিত এই জেলাতেও ছুঁয়ে গিয়েছে দামোদর। সেই দামোদর নদ নৌকাতে পেরিয়ে বুধবার প্রায় দিনভর ভোট (WB Panchayat Poll) প্রচার করল শাসকদল তৃণমূল। এখনও বিছিন্ন দ্বীপ হয়ে থাকা গাংটিকুলি। ১৭ বছর আগের বিতর্ক সরিয়ে উন্নয়নের আবহ।
পুরুলিয়ার নিতুড়িয়া ব্লকের শালতোড় গ্রাম পঞ্চায়েতের গাংটিকুলি। প্রায় দামোদর নদের মাঝে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এই গ্রাম। এক পাশে পশ্চিম বর্ধমান। আরেক পাশে ঝাড়খণ্ড। তার মাঝে এই জনপদে হাতে গোনা মোট ১০টি পরিবার। ভোটার ৫৩। সেই ভোটের জন্য ১৫ মিনিট নৌকা করে দামোদর পার হয়ে এদিন নিতুড়িয়া ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা ওই গাংটিকুলিতে পা রাখেন। রাজ্যের গুচ্ছ প্রকল্পের সুফল তুলে ধরে ভোটপ্রচার চলে তাঁদের। নকল ব্যালটপত্র হাতে দিয়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিন প্রার্থীর নাম জানিয়ে প্রচার হয়। গ্রামসভায় রেণুদেবী শর্মা, সমিতিতে ববিতা বাউরি, পাসোয়ান, জেলা পরিষদে সন্তোষী দত্ত বাউড়ি। হয় খাটিয়া বৈঠকও। নিতুড়িয়া ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা নিতুড়িয়া পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি শান্তিভূষণ প্রসাদ যাদবের নেতৃত্বে এই প্রচার চলে। তবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এই জনপদে বিদ্যুৎ না থাকায় ভোট প্রচারে এসে মৃদু ক্ষোভের কথা শুনতে হয় স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বকে।
তবে নিতুড়িয়া ব্লক তৃণমূল সভাপতি বলেন, “বিদ্যুৎ পরিষেবা ছিল। বিল সংক্রান্ত একটি কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমরা সোলার আলোর ব্যবস্থা করেছি। সমগ্র গ্রামজুড়ে যাতে এই ব্যবস্থাকে জুড়ে দেওয়া যায় তার প্রক্রিয়াও শুরু করব। দামোদর নদের প্রায় মাঝখানে এই গ্রাম হলেও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা আমরা এখানে পৌঁছে দিয়েছি। ফলে এই এলাকা আমাদের মজবুত জায়গা। এই এলাকাকে ঘিরে পর্যটন প্রকল্পের জন্য রাজ্যের কাছে প্রস্তাব পাঠানো রয়েছে।” সুদূর উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলা থেকে এই গ্রামে প্রায় ১০০ বছর আগে পা রাখেন সাউ ও কুইরি পরিবার। তখন অবশ্য কয়লাখনি জাতীয়করণ হয়নি। দুটি খনি থেকে একটি বেসরকারি সংস্থা কয়লা উত্তোলন করত। কোলিয়ারি এলাকাকে ঘিরে এখানে ছিল আধিকারিকদের বাংলো। এমনকী স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। তবে শালতোড় কোলিয়ারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই এলাকাও যেন রুগ্ন হয়ে যায়। একের পর এক পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হতে থাকেন মানুষজন।
কিন্তু তারপরেও কেন এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে মানুষের বসবাস? আসলে দামোদর নদ ছুঁয়ে থাকা এই জনপদে প্রচুর চাষাবাদ হয়। একবার আমন ধান চাষ হলেও হয় গম। সেই সঙ্গে বছরভর সবজি। তাই এখানকার মানুষজন নদী পেরিয়ে শালতোড়, পারবেলিয়া বাজারে বসবাস করতে চান না। স্থানীয় বাসিন্দা সঞ্জয় সাউ বলেন,”আমাদের তো কোন চাকরি নেই। তাই শহরাঞ্চলে থাকি না। আমাদের জীবন-জীবিকা চাষাবাদ আর প্রাণীপালন করেই। তাই কষ্ট হলেও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা জনপদেই চাষাবাদ আর প্রাণীপালন করে দিন গুজরান হয়। এই জন্য সরকারের তরফে সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। তবে বিদ্যুৎ-সহ যদি আরও নানা পরিষেবা পেতাম তাহলে ভাল হত। ভোট প্রচারে আসা জনপ্রতিনিধিদের আমরা সে কথাই এদিন বলেছি।”
তবে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গাংটিকুলিকে ঘিরে বাম আমলে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। অবৈধ কয়লা খননে প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে অভিযোগ। কিন্তু একটা মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। তবে এখন এসব অতীত। আর সেই বিতর্কে ঢুকতে চান না কেউ। স্থানীয় বাসিন্দা জংলি কুইরি, জানকী দেবী বলেন, “চাষাবাদের ফসল আমরা পারবেলিয়া বাজারে বিক্রি করি। ফসল বেচেই আমাদের বেশি আয় হয়।” তবে গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলেও উন্নয়নের আলোয় স্বনির্ভর হওয়া বিনোদ কুইরি, সুশীলা, কান্তি দেবীরা নৌকায় দামোদর পার হয়ে শালতোড়ে বুথমুখী হবেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.