সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: রাতের দিকে ট্রেন স্টেশনে ঢুকলেই ইঞ্জিনের দিকে একটি ছায়ামূর্তি দৌড়ে আসে। মধ্যরাতে চাদর মুড়ে ঘোরাফেরা করে কেউ! স্টেশনের পিছনে থাকা কুয়ো থেকে আর্তনাদ শোনা যায়।
মনে আছে সেই বেগুনকোদর স্টেশনের কথা? ওই বেগুনকোদর স্টেশনে ভূত দেখাতে পারলে এবার ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করলো পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা শাখা। শনিবার ভূত চতুর্দশীর প্রাক্কালে শুক্রবার দুপুরে একটি ভিডিও বার্তায় পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তথা চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায় এই পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে স্টেশনের ভূত-ভূত আবহ নিয়ে ‘ঘোস্ট ট্যুরিজম’ বা ইউটিউবারদের দৌরাত্ম্যের চরম সমালোচনা করেন ওই ভিডিও বার্তায়।
যদিও গত বছর ভূত চতুর্দশীর প্রাক্কালে ওই বেগুনকোদর এলাকার বাসিন্দা রেলকে জমি দেওয়া কৃষক অঙ্গদ কুমার ৫৬ বছরের বেগুনকোদরের ভূত রহস্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও ভৌতিক বিষয়টা রয়েই গিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব রেলের রাঁচি ডিভিশনের পুরুলিয়ার কোটশিলা থানার অন্তর্গত এই বেগুনকোদর স্টেশনে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা।
ওই সংগঠনের পুরুলিয়া জেলা সাধারণ সম্পাদক তথা চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভূত বলে কিছু নেই। বেগুনকোদর স্টেশনে রাত জেগে আমরা ও প্রশাসন মিলে তা প্রমাণ করে দিয়েছি। তাই বেগুনকোদরে ভূত দেখাতে পারলে আমরা ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেব।” ২০১৭ সালের ২৮শে ডিসেম্বর এই বেগুনকোদর স্টেশনে রাত জেগে প্রশাসন ও বিজ্ঞান মঞ্চ প্রমাণ করেছিল এখানে কোন ভূত নেই। তবে ভূতের আবহ জিইয়ে রাখতে একটা চক্র কাজ করছে। কিন্তু সেই চক্র কারা? ওই চক্রও কি ভুতুড়ে? তার অবশ্য সুনির্দিষ্ট খোঁজ পাইনি প্রশাসন। আজও। রেলের ওই জমিদাতা ৭২ বছরের অঙ্গদ কুমার বলেন, “এই বেগুনকোদর স্টেশনে ভূত বলে কিছু নেই। সবই বানানো গল্প। তৎকালীন স্টেশন মাস্টার বৈদ্যনাথ সরকারের চারটি মেয়ে ছিল। এলাকায় তারা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। তাই ওই স্টেশন মাস্টার এখান থেকে বদলি নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বদলি আর কিছুতেই হচ্ছিল না। সেজন্যই তিনি ভূতের গল্প বানিয়েছিলেন।”
১৯৬০ সাল নাগাদ এই স্টেশন গড়ে ওঠে। স্টেশন মাস্টার ছাড়াও তখন আরেকজন কর্মী ছিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের রাঁচি ডিভিশনের স্টেশনের পাশের গ্রাম বামনিয়া। কিন্তু মৌজা বেগুনকোদর। তাই এই স্টেশনের নাম হয় বেগুনকোদর। বছর ছয়েক চলার পরে স্টেশন মাস্টারের বানানো ভূতের গল্পের কারণে ১৯৬৬ সালে দরজাই বন্ধ হয়ে যায় এই স্টেশনের। ২০০৬ সাল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া শাখা এই ভূতুড়ে স্টেশনের তকমা গুচিয়ে পুনরায় চালু করতে রেলের তৎকালীন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার দ্বারস্থ হন। তার উদ্যোগে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই স্টেশন ফের চালু হয়। কিন্তু রেল শর্ত দেয় শুধু দিনের বেলায় এই স্টেশনে ট্রেন থামবে। একজন এজেন্ট দিয়ে সেখানে টিকিট বিক্রি করা হবে। তারপর থেকে সেই রেওয়াজ আজও চলছে।
তবে স্টেশনে যে ভূত নেই এই বিষয়টি বিজ্ঞান মঞ্চ সেইসঙ্গে প্রশাসন প্রমাণ করার পর এখন রাতে ট্রেন থামছে। কিন্তু ভূত-ভূত আবহে গা ছমছমে ভাব যে কাটছেই না। ভূত চতুর্দশীর আগে ভয়টা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে গ্রাস করেছে। তবে তা সামাজিক মাধ্যমে। ওই স্টেশনে পা রেখে এমন কোন অনুভূতি হয়নি। এলাকার মানুষজনও পরিষ্কারভাবে সেই কথা জানিয়ে দিয়েছেন। রেলের তথ্য অনুযায়ী, এই ষ্টেশন থেকে ফি দিন প্রায় ২০০ জনের বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন। দিনের বেলায় পাঁচটি লোকাল ট্রেন স্টেশনে স্টপেজ দেয়।
কিন্তু স্টেশনে সেভাবে আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকারে ঢেকে যায় এই স্টেশন। তখন বেগুনকোদর স্টেশন লেখা অক্ষরগুলোও আর বোঝা যায় না। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিঁঝি পোকার ডাকে পরিবেশটাই যেন কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। আর এই পরিবেশকে সামনে রেখেই এই স্টেশনে ভূত-ভূত আবহ জিইয়ে রেখে ইউটিউবররা লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছেন বলে অভিযোগ। ইউটিউবার এবং বিভিন্ন প্রযোজক সংস্থা এখনও বেগুনকোদরকে ভূতুড়ে স্টেশন বলতে থাকলেও এলাকার মানুষ কিন্তু ভূতের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার করছেন। কুসংস্কার বনাম বিজ্ঞান লড়াই চলছে এই ইন্টারনেটের যুগেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.