দেবাদৃতা মণ্ডল, হুগলি: ছেলের কাছে শিক্ষা নেয় অনেক কচিকাঁচা। কিন্তু আখেরে দেখা গেল, সে শুধু পেশায় শিক্ষকই হয়েছে। মানুষ হয়নি! জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে সেটা যখন বুঝতে পারলেন, বৃদ্ধ দম্পতি ততদিনে মাথার ছাদ হারিয়েছেন। ছেলে-বউমার হাতে একটানা শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়ে ভরসা হারিয়েছেন সংসারের উপর। শেষমেশ প্রতিকার মিলল ‘দিদিকে’ বলে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেল্পলাইনের দৌলতে পায়ের নিচে মাটি ফিরে পেয়ে এখন আপ্লুত চুঁচুড়ার ঘোষ দম্পতি।
ডানলপ কারখানার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী অজিত ঘোষ সারা জীবনের উপার্জন দিয়ে তিনতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন চুঁচুড়ার বুনোকালীতলায়। তার আগে দু’মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, একমাত্র ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেছেন। প্রাইভেট টিউটর হিসাবে এলাকায় নামও করেছে সেই ছেলে। সংসারী হয়েছে। স্ত্রী শ্যামলীদেবী ও ছেলে-বউমা-নাতনিকে নিয়ে শখের বাড়িতে বাকি জীবনটা সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দেবেন বলে আশা করেছিলেন অজিতবাবু।
কিন্তু, মানুষ ভাবে এক, হয় এক। যার জন্য সর্বস্ব পণ, সেই আত্মজই হয়ে উঠল চরম শত্রু! পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর চারেক যাবৎ শ্বশুর-শাশুড়ির উপর পুত্রবধূর অত্যাচার চলছিল। ক্রমে তা লাগামছাড়া হয়ে ওঠে। কটুবাক্য তো বটেই, বৃদ্ধ, অশক্ত মা-বাবার গায়ে হাত তুলতেও কসুর করত না গুণধর ছেলে জয়ন্ত। অভিযোগ, ছেলে আদতে বাড়ি হাতিয়ে মা-বাবাকে পথে বসানোর ছক কষেছিল। চার বছর আগে জালিয়াতি করে বাড়িটি নিজের বউ ও মেয়ের নামে লিখিয়ে নেয় সে। আর তারপরই শুরু অত্যাচারের পালা।
অপত্য স্নেহের বশে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবই মুখ বুজে সয়ে গিয়েছেন। একমাত্র ছেলে ও বউমার হাতে দিনের পর দিন অপমানিত, নিগৃহীত হয়েও লোক জানাজানি করেননি। কিন্তু গত মার্চে এক দিন যখন সস্ত্রীক অজিতবাবুকে বেধড়ক মারধর করে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হল, তখন আর কারও জানতে বাকি থাকেনি। খবর যায় মেয়েদের কাছে। অজিতবাবুর এক মেয়ে ঝর্না সরখেলের বাড়ি চুঁচুড়াতেই। আর এক মেয়ে রত্না ধর বেহালার বাসিন্দা। মেয়ে-জামাইরা ওঁদের নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। সেই ইস্তক মেয়েদের বাড়িই ভিটেছাড়া বৃদ্ধ দম্পতির ঠিকানা। মা-বাবার মাথার উপর ছাদ ফিরিয়ে দিতে মেয়েরাই জেলার পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারস্থ হন। মানবাধিকার কমিশনের কাছে আরজি জানান। সব শেষে মাথায় আসে ৯১৩৭০৯১৩৭০। মানে, ‘দিদিকে বলো।’
এক ফোনেই মুশকিল আসান! মুখ্যমন্ত্রীর দরবারে হতভাগ্য দম্পতির দুর্ভোগের কিসসা পেশ হতেই জেলা প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। মঙ্গলবার চুঁচুড়া থানার পুলিশ অফিসাররা অজিতবাবু-শ্যামলীদেবীকে পত্রপাঠ বুনোকালীতলার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। পাশাপাশি প্রশাসনের তরফে ছেলে জয়ন্তকে সতর্ক করা হয়। চুরাশি বছরের অজিতবাবু এহেন অভাবিত প্রাপ্তিতে ভাষা হারিয়েছেন। প্রশাসনকে পাশে পেয়ে প্রত্যয় ফিরে পেয়েছেন শ্যামলীদেবী। “নিজের পেটের ছেলের চরম অত্যাচার সহ্য করেছি। তবে এ বার আর ভয় পাব না।”,বলছেন তিনি। মা-বাবা বাড়ি ফিরে পাওয়ায় মেয়েরাও খুশি। কিন্তু পুরো ঘটনার কেন্দ্রে যে, তার কী প্রতিক্রিয়া? জয়ন্ত ঘোষের আচরণে অবশ্য একতিলও আক্ষেপ নেই। এ দিন তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, “কোনও দোষ করিনি। তবে প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলব।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.