ধীমান রায়, কাটোয়া: ছ’জনের দল রওনা দিয়েছিল কেরলের উদ্দেশ্যে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনেরই মৃত্যু হয়েছে। ফিরে এসেছে পাঁচটি লাশ। দুর্ঘটনার পর একমাত্র জীবিত শুকলাল সর্দার। ছেলে ও ভাগনা-সহ চারজনের মৃতদেহ একই চিতায় দাহ করে এসেছেন। শ্মশানযাত্রীরা দাহপর্ব সেরে সোমবার ভোরে করুই গ্রামে পা রাখতেই গ্রামজুড়ে শুধু স্বজন হারানোর আর্তনাদ। শুকলালের স্ত্রী, সন্তানহারা মা ঝর্ণাদেবী বলছেন, “সংসার চালাতে না পারলে লোকের কাছে হাত পাতব। তবু আর স্বামীকে কেরলে কাজ করতে যেতে দেব না।” একই কথা শুকলালের প্রতিবেশীদেরও। বাড়ির কোনও সন্তানকে আর ভিনরাজ্যে কাজে পাঠানোর কথা ভাবতেই পারছেন না করুই গ্রামের সর্দারপাড়ার বাসিন্দারা। দুর্ঘটনার বীভৎসতা দেখে শোকের পাশাপাশি প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে।
কাটোয়ার করুই এবং কৈথন পাশাপাশি গ্রাম। করুই গ্রামের বাসিন্দা শুকলাল সর্দার রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কেরলে রাজমিস্ত্রির কাজে মজুরি বেশি পাওয়া যায়। তাই প্রায় ৮ বছর ধরেই শুকলাল কেরলে কাজ করতে যেতেন। তাঁর সঙ্গে গ্রামের আরও কয়েকজন একই কাজে কেরলে যেতেন। ছুটি শেষে শুকলালরা আবারও করমণ্ডল এক্সপ্রেস ধরে কেরলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। শুকলাল জানান, তাঁরা সেদিন ৬ জন ছিলেন। করুই গ্রাম থেকে শুকলাল ও তাঁর ছেলে ছোট্টু সর্দার, সৃষ্টি রায়, সঞ্চিত সর্দার এবং কৈথন গ্রামের সাদ্দাম শেখ। এছাড়া মঙ্গলকোটের কৈচর গ্রামের বাসিন্দা কলেজ সর্দার সম্পর্কে শুকলালের ভাগনা। কলেজও ছিলেন এই দলে। মোট ছয়জনের মধ্যে শুকলালের রিজার্ভেশন টিকিট ছিল ওয়েটিং লিষ্টে। কলেজ-সহ বাকি ওই পাঁচজন ছিলেন অসংরক্ষিত কামরায় একইসঙ্গে।
শুকলাল বলেন,”আমি এস ৬ কামরায় ছিলাম। সিট না পেয়ে দরজার কাছে বসে ছিলাম। সাদ্দাম, ছোট্টু, সৃষ্টি, সঞ্চিত ও কলেজ ছিল একইসঙ্গে। সন্ধের মুখে হঠাৎ বিকট শব্দের পাশাপাশি ঝাঁকুনি। চারিদিকে ধোঁয়ায় ভরে যায়। বুঝতে পারি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কামরা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে ছোট্টুদের কামরার কাছে ছুটে যাই। দেখি, কামরার ভিতরে গাদাগাদি করে রক্তাক্তবস্থায় সবাই পড়ে রয়েছে। ছেলেকে তখনই দেখতে পাই। যারা বেঁচে রয়েছে বলে মনে হয়েছে, তাঁদের আগে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তারপর আমার ছেলের দেহ তুলে নিয়ে যাই।”
জানা যায়, শনিবারেই কৈথন গ্রামে নিয়ে আসা হয় সাদ্দাম শেখের দেহ। রবিবার গ্রামে দেহ কবরস্থ করা হয়। রবিবার রাতে বাকি চারজনের দেহ সঙ্গে নিয়ে শুকলাল গ্রামে ফেরেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই করুই গ্রাম থেকে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য সুকেশ চট্টোপাধ্যায়-সহ গ্রামের কয়েকজন ওড়িশা পৌঁছে যান। তাঁরাও মৃতদেহগুলি সঙ্গে নিয়ে ফেরেন। রবিবার রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ কাটোয়া শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় ছোট্টু, কলেজ, সৃষ্টি ও সঞ্চিতের দেহ। একই শ্মশানে চারজনকে দাহ করা হয়। ছেলের মুখাগ্নি করেন শুকলাল। মৃত সঞ্চিত সর্দারের তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে সীমা তাঁর বাবার মৃতদেহের মুখাগ্নি করেন।
অপরদিকে কৈচরের কলেজ সর্দারের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া করেন কাকা সঞ্জয় সর্দার। দাহপর্ব সেরে সোমবার ভোরে শবযাত্রীরা বাড়ি ফিরে আসেন। কলেজ সর্দার(২৬)-এর বাড়িতে রয়েছেন বিধবা মা, স্ত্রী ও দশ মাসের ছেলে। মা কৃষ্ণাদেবী বলেন,” আমার নাতিটার মুখেভাতের অনুষ্ঠানের জন্য ছেলেটা বাড়ি এসেছিল। মুখে ভাত হওয়ার পর মাঠে ধান তোলার কাজের জন্য কিছুদিন থেকে রায়। তারপর আবার কাজের জায়গায় যাচ্ছিল। পুরো সংসারটা ভেসে গেল।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.