চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় ও সুমিত বিশ্বাস: “মাগো কী শুনছি দেশে? তোমার ছিল ঘরবাড়ি ওই কাশীপুরের টাঁড়ে / রাজকন্যা হয়েও করবে দেশছাড়া / আছে কি তোমার প্রমাণপত্র ওই সরকারের নীড়ে? নইলে তোমায় পুছবে না এদেশে / … মাগো কী শুনছি দেশে?”
বুধবার সংক্রান্তি। ওইদিন হবে টুসুর বিদায়। তার আগে দিন ও রাতভর গানে গানে জাগরণ হয় টুসুর। NRC ও CAA’র কথা শোনা গেল সেই গানের সুরে। কোনও রাজনৈতিক মঞ্চে নয়, আসানসোলের একেবারে সাধারণ ছাপোষা বাঙালি পরিবারের টুসুর আবাহনে এই সুর শোনা গেল মঙ্গলবার। পুরুলিয়ায় ভাষা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল টুসু গান। এবার সেখানে উঠে এল NRC-CAA প্রসঙ্গ।
অগ্রহায়ণ মাসের শেষ থেকে রাঢ় বাংলায় শুরু হয় টুসুর আরাধনা। গানের মধ্য দিয়েই হয় টুসু বন্দনা। দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনের আনন্দবেদনার মাঝখানে ঈশ্বরকে প্রিয়রূপে আবাহনের গান। শ্রমজীবী স্বল্পশিক্ষিত গ্রাম্য নারী বিরচিত এবং সুরারোপিত টুসুগান। ইদানীং পুরুষেরা গান বাঁধেন, সুর দেন বা গান করেন। ঝিমধরা সুরে আর রিনরিনে গ্রামীণ মহিলাদের কণ্ঠে শোনা গেল নাগরিক পঞ্জির কথা।
কুলটির মিঠানি গ্রামে প্রয়াত গান্ধীবাদী কংগ্রেস নেতা সুধীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারে রয়েছে টুসুর প্রচলন। সুধীরবাবু একাধারে নাট্যকার ছিলেন অন্যদিকে ছিলেন সমাজসেবী ও কংগ্রেস নেতা। তাঁর ভাইপো জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায় টুসুর পরম্পরা অব্যাহত রেখেছেন। একমাস আগে টুসু পেতেছেন। পরিবারের ছেলে মেয়ে গৃহবধূ সবাইকে নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় হয়েছে টুসুর আরাধনা। মঙ্গলবার টুসুর শেষ আরাধনা। ওইদিন বলা হয় জাগরণ। জাগরণের দিন টুসুর গানে সংযোজিত হলো NRC। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের গৃহবধূ সুলেখা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘টুসুকে বাড়ির মেয়ে হিসেবেই আমরা কল্পনা করি।
পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন থেকে সারারাত ধরে হয় পুজো। টুসু গান। যেখানে নিত্যদিনের সুখ, দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাই বলা থাকে। এই গান রচনা করেন স্থানীয়রাই। পরদিন ভোরবেলা সকলে মিলে নদীতে স্নান করতে যাব। সেখানেই ভাসানো হবে টুসুকে।’ জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘টুসু প্রাচীন ও ঐতিহ্যের পরব। এখনকার প্রজন্ম বিশেষ করে মানভূম সীমানার আসানসোলে এই প্রচলন উঠেই গেছে। কিন্তু সোশাল মিডিয়ার কালচার সরিয়ে আমরা এই টুসু পরবকে বাঁচিয়ে রেখেছি।’
রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের সেই সাবেক মানভূম পুরুলিয়ায় লোকসংস্কৃতি গবেষকদের টুসু গানে ধরা পড়ল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিক পঞ্জির কথা। উঠে এসেছে প্রতিবাদও। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় লিখেছেন, “দেশে নিত্য লতুল আইন হছ্যে / রেশন, ভোটার, আধার কার্ডেও / সঠিক প্রমাণ নাই হছ্যে।” এই টুসু গানের কথাতেই উঠে এসেছে প্রতিবাদ। তাঁর গানে ধরা পড়েছে, “সাত পুরুষ ধরে বাস করছি / ইটার প্রমাণ দিব কার কাছে”। গানের শেষের কথায় রয়েছে, “জমি, গুড়া, ডভা, পইখর / ছেল্যার ছেল্যা দেখিছে / দলিল, পড়চা নাইবা রইল্যা / জমি গুলা তো আছে / এনআরসিতে দেশটা মাত্যেছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.