Advertisement
Advertisement
Nolen Gur hub

‘দুয়োরানি’ খেজুর গাছ, প্রশাসনিক টালবাহানায় রঘুনাথপুরে অথৈ জলে নলেন গুড়ের হাব

এগোয়নি ব্র্যান্ডিংয়ের কাজও।

Nolen Gur hub of Purulia's Raghunathpur faces trouble । Sangbad Pratidin
Published by: Sayani Sen
  • Posted:December 3, 2023 5:57 pm
  • Updated:December 3, 2023 5:57 pm  

সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: কখনও রাস্তার মতো সরকারি প্রকল্প। বা অন্য কোন মেগা প্রজেক্ট। কিংবা ইটভাটার আঁচ জ্বালতে যত্রতত্র কোপ পড়ছে নলেন গুড়ের জোগানদার খেজুর গাছে। এই ছবি এখন বাংলার প্রায় সব জেলাতেই। কিন্তু পুরুলিয়াজুড়ে চারপাশে শুধুই খেজুর বন। কিন্তু নলেনের মৌতাত জোগাবে কে? ভিন জেলা থেকে ফি বছর শীতে গুটিকয়েক শিউলি এসে এই বিপুল সম্ভাবনাময় নলেন গুড়ের শিল্পকে তো আর যাই হোক, ক্ষুদ্র শিল্পের রূপ দেওয়া যায় না। তাই অথৈ জলে রঘুনাথপুর শিল্পতালুকে প্রস্তাবিত নলেন গুড় হাব প্রকল্প। জঙ্গলমহলের এই খেজুর গুড়কে আরও ব্যাপক হারে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দিতে ব্র‍্যান্ডিংয়ের কাজও লাল ফিতের ফাঁসে আটকে।

আসলে এই অবহেলার কাহিনি খানিকটা নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘রস’-এর মতো। অন্য নারীর রূপে মজে নলেন গুড়ে জাল দেওয়াতে পারদর্শী বিবি মাজু খাতুনকে তালাক দিয়েছিলেন শিউলি মোতালেফ মিয়া। নতুন বউ ফুলবানুকে ঘরে এনেছিলেন।কিন্তু রসের মরশুমে দেখা গেল, মাজুর জাদু নেই তার হাতে। তার পাক দেওয়া গুড় বিক্রি হচ্ছে না হাটে। ফলে লাটে উঠেছিল ওই শিউলির নলেন গুড়ের ব্যবসা। ঠিক তেমনই যেন অবস্থা বনমহল পুরুলিয়ায় অজস্র খেজুর গাছকে ঘিরে এই গুড় তৈরির শিল্পের। স্রেফ কদর না দেওয়াতেই এই শিল্প মার খাচ্ছে জঙ্গলমহলের এই জেলায়।

Advertisement

এবার, একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জেলায় বিপুল খেজুর গাছ দেখে নলেন গুড়ের শিল্পের কথা বলেছিলেন। সেই মোতাবেক কাজও শুরু হয়। তৎকালীন জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে পুরুলিয়ার গুড়কে প্যাকেজিং করে ব্র্যান্ডিং দেওয়ার তোড়জোড় চলে। তারপর আরও কয়েকটা ধাপ এগিয়ে ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে রঘুনাথপুরের তৎকালীন মহকুমাশাসক আকাঙ্ক্ষা ভাস্করের চেষ্টায় পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের অর্থে ওই শিল্পতালুকে নলেন গুড় হাব করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমলা
রদবদলে প্রশাসনিক উদাসীনতায় ওই প্রকল্প আর বাস্তবের মুখ দেখল না।

বনমহল পুরুলিয়ায় খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধার মন ভেস্তেই গেল। অথচ নদিয়ায় শুধুমাত্র ব্যাপক হারে শিউলিরা থাকায় এই খেজুর গাছ পরিচর্যায় ‘রোড ম্যাপ’ গড়ে তুলেছে রাজ্য। রাজ্য খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদের নলেন গুড় প্যাকেজিং আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব প্যাকেজিং-র সহায়তায় নলেন গুড় টিউব বন্দি হয়েছে। তা মেলে বিশ্ব বাংলার স্টলে। আর সেই টিউব নিয়ে যাচ্ছেন এই নলেনের নেশায় আচ্ছন্ন বিদেশীরাও। ফলে রাজ্য খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধতে মন দিলেও এই জেলা প্রশাসন যে একেবারেই উদাসীন।

[আরও পড়ুন: খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধলেও গুড় কই? পৌষপার্বণ নিয়ে চিন্তিত মহলদারেরা]

তবে পুরুলিয়া জেলা উদ্যান পালন আধিকারিক কৃষ্ণেন্দু নন্দন বলেন, “কমার্শিয়াল হটিকালচারের মধ্যে সেভাবে খেজুর গাছ পড়ে না। কিন্তু পুরুলিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র খেজুর গাছকে ঘিরে প্রক্রিয়াকরণের মধ্য দিয়ে একটা বড় শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই আমাদের নানান ভাবনাচিন্তা চলছে। কৃষি বিপণনের সাহায্য নিয়ে এই নলেন গুড়কে প্যাকেজিং করে ব্র্যান্ড দেওয়া যেতেই পারে।”

তবে এই কাজে খানিকটা এগিয়ে পড়শি জেলা বাঁকুড়া। কৃষি বিপণন বিভাগ থেকে ফার্মার্স প্রডিউসার অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে নলেন গুড় তৈরির কাজ চলছে। এছাড়া এই কাজ পুরুলিয়ায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে জেলা শিল্প কেন্দ্রও। ২০ জন কৃষক নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ করার প্রকল্প যে ওই দফতরের হাতে আছে। কিন্তু শিল্প কেন্দ্রের কোন উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ। জেলা শিল্প কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার জয়ন্ত আচার্য বলেন, ” খেজুর গাছকে নিয়ে এই জেলায় বিপুল সম্ভাবনা আছে ঠিকই। কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোন প্রস্তাব আসেনি। প্রস্তাব না হলে আমরা কীভাবে এগবো?”

যখন প্রস্তাব না আসার কথা বলছে জেলা শিল্প কেন্দ্র। তখন এই জেলায় পা রেখে নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের শিউলিরা এই জেলার মাটিতেই অস্থায়ী তাবু পুঁতে রসের মরশুমে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে বাড়ি ফিরছেন। জঙ্গলমহলের নলেন গুড়ের যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। সেই কারণেই জয়নগরের মোয়া তৈরিতেও এই গুড় প্রয়োজন হয়। এছাড়া গেরস্থ বাড়িতে দুধ, মুড়ি, চিড়ে,খই, রুটিতে নলেন গুড় মেখে জলখাবার তো আছেই। রয়েছে পিঠে,পুলি পায়েস তৈরি। এছাড়া গুড় দিয়ে নানান মিষ্টি তৈরি হওয়ায় এই বনমহল থেকেই রফতানি হচ্ছে বাংলা- ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গায়। নলেন গুড়ের আইসক্রিমের জন্যও এই গুড় যাচ্ছে। বিশ্ব বাংলা স্টলের হাত ধরে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশেও।

নদিয়ার দেবগ্রাম থেকে পুরুলিয়ার পাড়ার গ্রামে খেজুর গুড় তৈরি করতে আসা শিউলি টুটুন শেখ বলেন, ” নদিয়ায় তো খেজুর গাছ বেশি নেই। যা আছে ব্যক্তিগত। আর এখানে জঙ্গলের পর জঙ্গল শুধু খেজুর বন। এই খেজুর রস থেকে গুড় বেশ ভালো হয়। তাই ফি বছর আমরা এখানে এসে এই ‘সোনালী তরল’ বেঁচেই মোটা টাকা আয় করি। কারন স্থানীয় মানুজন এই গুড় বানাতে জানেন না। ফলে খেজুর গাছ অবহেলা, অনাদরেই পড়ে থাকে। আমরাই যা ব্যবহার করি। তবে সেটা খুবই কম।” মূলত এই গুড় থেকে নলেন পাটালি, সেই সঙ্গে বড় বড় পাটালিও তৈরি হয়। ১৫০ টাকা কেজি দরে নলেন গুড়। ২০০ টাকা কেজি দরে নলেন পাটালি। অবশ্য বড় পাটালি পাইকারি হারে ৭০ টাকা থেকেই পাওয়া যায়।

শুধু খেজুর গাছ থাকাই নয়। খেজুর রস পেতে হলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকতে হবে টানা বেশ ক’দিন। এই মরশুমে প্রকৃতি যা এখানে ধারাবাহিকভাবে দেয়। খেজুর রসও যে আলাদাভাবে বিপণন করা যায় তা বলছে উদ্যানপালন বিভাগ। এই খেজুর রসের জন্য ভাদ্র মাস থেকে গাছ কামানোর কাজ শুরু হয়। কার্তিক মাসের শেষ থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত রস পাওয়া যায়।

সপ্তাহে প্রতিটি গাছ থেকে তিন দিন রস নেওয়া যায়। চার দিন বিরাম দিতে হয়। কারণ ওই দিনগুলিতে রসে শর্করার পরিমাণ খুবই কম থাকে। গাছ প্ৰতি তিন দিনে গড়ে মোট ১৮ থেকে ২১ লিটার রস পাওয়া মেলে। ১০ লিটার রসে গুড় পাওয়া যায় এক কেজি। জ্বালানি সহ আনুসাঙ্গিক খরচ হয় কেজি প্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা। এই নলেন গুড় ১৫০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় লাভও অনেকখানি। এছাড়া লিটার প্রতি প্রায় ২৫ টাকা দরে খেজুর রস বিক্রি হয়। এর থেকেই বোঝা যায় এই জেলার মত সম্ভাবনা এলাকায় মোটা মুনাফার বাণিজ্য লুকিয়ে রয়েছে।কিন্তু স্রেফ প্রশাসনিক উদাসীনতায় মুখ থুবড়ে নলেন গুড় শিল্প।

[আরও পড়ুন: উষ্ণ ডিসেম্বর! ঘূর্ণিঝড় ‘মিগজাউম’ কাঁটায় একধাক্কায় ৫ ডিগ্রি বাড়ল বঙ্গের তাপমাত্রা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement