সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সীমান্তবর্তী এলাকায় জিহাদি ক্যাম্প। সেখানেই চলত আল কায়দা (al Qaeda)’র বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ। সহজলভ্য বস্তু আইইডি ও বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। তেমনই সহজলভ্য অথচ শক্ত ধাতু দিয়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তৈরি করে ফেলেছিল জঙ্গিরা। ফলে সরাসরি দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আঘাতের ছক তাদের ছিল বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। একই সঙ্গে কখনও বা ওসামা বিন লাদেন, আবার কখনও আল জোহরির বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ শুনিয়ে চলত মগজ ধোলাই। গত দু’বছরে চার জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে আল কায়দার মডিউল তৈরির কাজ করেছিল এনআইএ-র হাতে ধৃত জঙ্গিরা। এই রাজ্যের আল কায়দার নেটওয়ার্কের নাটের গুরু আল মামুদ কালামকে প্রাথমিক জেরা করে এই তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দাদের দাবি, যেহেতু জেএমবি (JMB) ও নিও জেএমবি (Neo JMB) মডিউলগুলি কলকাতা পুলিশ ও এনআইএ (NIA) ভেঙে দিয়েছে। তাই এবার নতুন করে ওই একই জেলাগুলিতে ঘাঁটি তৈরি করছে আল কায়দা জঙ্গিরা। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, পাকিস্তানের পেশোয়ারে বসে আল কায়দার জঙ্গি নেতারা মদত দিয়ে চলেছে ভারত ও বাংলাদেশের ‘আল কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট’ বা ‘আকিস’। আকিস বাংলাদেশ শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। এদিকে, কেরলের এর্নাকুলাম ও বেঙ্গালুরুতেও রয়েছে জঙ্গিদের ঘাঁটি। এর আগেও কেরল থেকে একাধিক আইএস ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের মডিউল ভেঙেছেন গোয়েন্দারা।
তাঁরা জানিয়েছেন, বছর কয়েক আগে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থানা এলাকার নওদাপাড়ার বাসিন্দা আল মামুদ কালাম কেরলে রাজমিস্ত্রি কাজ করতে যায়। সেখানেই তার পরিচয় হয় মুর্শিদ হাসান, ইয়াকুব বিশ্বাস, মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। তারাও মুর্শিদাবাদের রানীনগর, ডোমকল ও জলঙ্গির বাসিন্দা। এর্নাকুলামে থেকে মিস্ত্রির কাজের আড়ালে চালায় মগজ ধোলাই। এর্নাকুলাম থেকে ওই তিনজনকেই এনআইএ গ্রেপ্তার করে। কেরলে আল মামুদ কালামের মগজ ধোলাই হয়। গোয়েন্দারা জেনেছেন, কেরলের গোপন ডেরায় আইইডি ও বিস্ফোরণ বানানোর প্রশিক্ষণ নেয় কালাম। এর্নাকুলামের বাকিদেরও রয়েছে এই প্রশিক্ষণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা পাকিস্তানের সঙ্গে হ্যান্ডলারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। যেহেতু বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সহ কয়েকটি জায়গায় আল কায়দার মদত পাওয়া আকিস ও এবিটি শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। তাই কালামকে বলা হয় বাংলাদেশের জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই রাজ্যে মডিউল তৈরি করতে। দুবছর আগে মুর্শিদাবাদে ফেরে সে।
জঙ্গি নিয়োগের কাজ শুরু করতেই কালামের সঙ্গে পরিচয় হয় ডোমকলের বাসিন্দা ও ডব্লিউবিএসইডিসিএলের (WBSDCL) অস্থায়ী কর্মী লিউ ইয়ান আহমেদের। একটি কলেজের পরীক্ষাগারের সঙ্গে যুক্ত সে। সেই সূত্রে বৈদ্যুতিক সার্কিট তৈরীর কাজে পোক্ত। লিউ ইয়ানকে দিয়েই শুরু হয় আইইডি বানানোর প্রাথমিক কাজ। এর মধ্যেই মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদা ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বেশ কয়েকজন যুবক ও তরুণের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ হয় আল কায়দার। তাদের একটি অংশ কলেজ ছাত্র। আবার কেউ বা ছোটখাটো কাজ করে। বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রদেরই বেশি পছন্দ জঙ্গি নেতাদের। এনআইএর হাতে মুর্শিদাবাদের যে ৬ জন ধরা পড়েছে, তাদের মধ্যে নাজমুস সাকিব ডোমকলের কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই যুবকদের জঙ্গি নেতারা সিএএ ও এনআরসি বিরোধী প্রচারের নাম করে মগজ ধোলাই শুরু করে।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আল কায়দা নেতাদের নির্দেশেই কামাল ও লিয়ান শুরু করে মগজ ধোলাই। জানা গিয়েছে, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা ও মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী এলাকার কয়েকটি জায়গায় রীতিমতো ক্যাম্প করে থেকে জঙ্গি নিয়োগ শুরু করে তারা। পছন্দমত কয়েকজনকে দেওয়া হয় বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ। চোরাপথে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে কয়েকজন বাংলাদেশি জঙ্গি নেতা এসে বক্তৃতা দেয়। বাংলাদেশে যেত কালাম, লিউ ইয়ানরাও। শিবিরে সহজে বোমা, বিস্ফোরক ও আইইডি তৈরির প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ওসামা বিন লাদেন, আল জোহরি ও আল কায়দার অন্যান্য নেতাদের বক্তৃতাও শোনানো হয়। প্রচুর জেহাদি বই ও লিফলেটের বাংলা অনুবাদ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে চলে আসে এই রাজ্যের জঙ্গিদের হাতে। শুরু হয় মডিউল তৈরির কাজ। পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আল কায়দার এই জঙ্গিরা ব্যবহার করত একটি বিশেষ অ্যাপ। এই অ্যাপেই জঙ্গি নেতাদের পাকিস্তান থেকে বলা হয় কোন কোন জায়গায় নাশকতার ছক কষতে হবে। ধৃতদের মোবাইল থেকে সেই অ্যাপের সন্ধান মিলেছে তার সূত্র ধরেই চলছে তদন্ত।
মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি, ডোমকলে ধৃত ৬ জন জঙ্গির বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে যে ল্যাপটপ, মোবাইল, পেন ড্রাইভ পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে উদ্ধার হয়েছে বহু আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেতার ছবি ও তাদের বক্তৃতার ভিডিও। বোমা ও বিস্ফোরক তৈরির বহু স্কেচ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে। অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরির বড় মূল দায়িত্ব ছিল লিয়ান আহমেদের উপর। তার বাড়ি থেকে প্রচুর বৈদ্যুতিক সার্কিট, আইডি তৈরির সরঞ্জাম ও বর্ম অথবা দিশি পদ্ধতিতে ধাতু দিয়ে তৈরি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও পাওয়া গিয়েছে।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, জঙ্গি নেতাদের বলা হয়েছিল টাকার অভাব হবে না। সেই কারণে পাকিস্তান থেকে ঘুরপথে টাকা আসত এই রাজ্য ও দক্ষিণ ভারতের জঙ্গিদের কাছে। প্রত্যেক সদস্যকে বলা হত, খুব সাধারণভাবে থাকতে, যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। বাংলাদেশ থেকে এই রাজ্যের জঙ্গি নেতাদের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হত। এছাড়াও সরাসরি পাকিস্তানের আল কায়দা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল জঙ্গি নেতাদের। ধৃতদের জেরা করে এই রাজ্যের আরও কয়েকজন জঙ্গি নেতাকে খোঁজার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.