স্টাফ রিপোর্টার : রাজ্যের প্রবল চাপের মুখে পড়ে অবশেষে সাধারণতন্ত্র দিবসের (Republic Day 2022) কুচকাওয়াজে ফিরিয়ে আনতে হল নেতাজিকে! সুভাষচন্দ্র বসুর (Subhash Chandra Bose) জীবন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তৈরি পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো (Tableau) বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর পরই দেশজুড়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক ও সমালোচনায় বিদ্ধ হয়ে শেষপর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিজেই নেতাজির ট্যাবলো কুচকাওয়াজে রাখতে চলেছে। যদিও বলা হচ্ছে, কেন্দ্রের নেতাজির ট্যাবলো রাখার জন্যই রাজ্যের ট্যাবলো বাদ গিয়েছে।
রবিবার এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে তাঁর তীব্র অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের এমন ট্যাবলো-কাণ্ডে ক্ষুব্ধ নেতাজির পরিবারের সদস্যরাও। নেতাজি-কন্যা অনিতা বসু পাফ জার্মানি থেকে পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার নেতাজি সম্পর্কে কেন উদাসীন তা জানতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখছেন।
তাঁর বক্তব্য, কোন পরিস্থিতিতে ট্যাবলো স্থান পেল না, তা জানি না। নেতাজির ১২৫তম জন্মদিবসে সাধারণতন্ত্র দিবসে প্যারেডে ট্যাবলো বাতিলে আমি হতবাক। আগের বছর কলকাতায় বড় আকারে নেতাজির জন্মদিন পালিত হয়। নির্বাচনের কারণেই হয়তো বড় করে নেতাজির জন্মদিবস পালিত হয়েছিল। এবছর তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। এই ইস্যু হয়তো তাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি একটি অনুষ্ঠান অনেক মানুষকে ছুঁয়ে যেতে পারে, তাহলে সেটা করা উচিত।
নেতাজির নাতি তথা বসু পরিবারের মুখপাত্র চন্দ্রকুমার বসু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর দাবি, রাজনাথ তাঁর সচিবের মাধ্যমে তাঁকে জানিয়েছেন, সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নেতাজিকে নিয়ে একটি বিশেষ ট্যাবলো তৈরি করেছে। তবে বিষয়টি রাজ্যকে কেন জানানো হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তবে কেন্দ্রীয় সরকার যতই নেতাজি-ট্যাবলো বাতিল করুক না কেন, রাজ্য সরকার তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নেতাজির জীবন ও সংগ্রামের বিষয় নিয়েই এবার ট্যাবলো করছে রেড রোডের কুচকাওয়াজে।
নবান্ন সূত্রে খবর, সাধারণতন্ত্র দিবস উদযাপন নিয়ে এদিন বৈঠক করেন প্রশাসনিক শীর্ষকর্তারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির জেরে এবার সংক্ষিপ্ত করা হচ্ছে অনুষ্ঠান। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কলকাতা পুলিশ কুচকাওয়াজে অংশ নিলেও থাকছে না ছাত্রছাত্রীদের কোনও অনুষ্ঠান। মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য অনুষ্ঠান হবে। সেখানে কলকাতা পুলিশের পাশাপাশি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উপর ট্যাবলো থাকছে।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার সকাল থেকে হঠাৎই সক্রিয় হয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে। কখনও তথাগত রায় কখনও দিলীপ ঘোষ, সবাই সমাজ মাধ্যমে সরব। বাদ যায়নি বাম-কংগ্রেসও। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের বক্তব্য, তাতে শাক দিয়ে যে মাছ ঢাকা যাচ্ছে না, তা স্পষ্ট রাজ্যের বিজেপি নেতাদের বক্তব্যেই। ট্যাবলো কাণ্ডে বিজেপির মুখরক্ষায় সকালেই মাঠে নামেন তথাগত রায়। দলের গায়ে লেগে থাকা ‘বাংলা বিরোধী’ তকমা মুছতে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে টুইট করে রাজ্য বিজেপির বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন, অনুগ্রহ করে প্রজাতন্ত্র দিবসের উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলোর অনুমতি দিন। এতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বীরত্বের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। যাঁর সংগঠন আইএনএ ব্রিটিশ সেনার উপর ব্রিটিশদের বিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তাদের দ্রুত দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল।’
তথাগতর টুইটে এমন মুখরক্ষার চেষ্টা অবশ্য কিছুক্ষণ পরই আক্রমণের মুখে পড়ে। কটাক্ষের সুরে তৃণমূল সাংসদ ডা. শান্তনু সেনের টুইট, “মাঝে মাঝে বেশ কিছু অসংলগ্ন ও ভুল কথা বললেও ‘নোট ও নটীর বিনিময়ে টিকিট, কামিনী কাঞ্চন, দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, ব্যর্থ দল পরিচালনা’ এসবে বঙ্গ বিজেপির বাস্তব কঙ্কালসার চেহারা তুলে ধরেছেন অনেকবার। আজও বাংলার প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। এই শুভবুদ্ধি নিয়েই ভাল থাকবেন।”
শান্তনুর কথা যে চাঁদমারিতে গিয়ে লেগেছে, তা বোঝা গিয়েছে তথাগতর প্রত্যুত্তরে, “ভুল। পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রদর্শিত হোক, এই আবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে করেছি শুধু যাতে নেতাজি তথা অবিভক্ত বাংলার অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদান মানুষের চোখের সামনে আসে। ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ টাইপের সিপিএম-তৃণমূল-সুলভ রাজনৈতিক নাকে-কাঁদুনি সমর্থন করার জন্য নয়।” অন্যদিকে দিলীপ ঘোষের মত, ট্যাবলো নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “সেখানকার কমিটি সিদ্ধান্ত নেন ট্যাবলো চলবে কি না। যখন বাতিল হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঘুম ভাঙে। প্রায় বছরই এমন হয়। এর তদন্ত করা উচিত।”
ট্যাবলো বিতর্কে রাজ্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন লোকসভায় কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা অধীর চৌধুরী। বহরমপুরে তিনি জানান, নেতাজির ট্যাবলো যাতে বাতিল করা না হয়, তার জন্য রাজনাথ সিংকে চিঠি পাঠিয়ে আবেদন করেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “এই ঘটনা বাংলা মানবে না। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে কংগ্রেস।” মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর আবেদন, “মুখ্যমন্ত্রী চাইলে সবাই মিলে একসঙ্গে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিকল্পনা নেওয়া যাবে।”
সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বিজেপির সমালোচনায় সরব। তিনি বলেন, “এখন প্রমাণ হচ্ছে নেতাজি সম্পর্কে বিজেপির বা কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী। গতবছর বাংলায় ভোট ছিল তাই বিরাট এক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে সব ছিল লোকদেখানো। কারণ গত এক বছরে সেই কমিটির কোনও মিটিং হয়নি, কর্মসূচিও হয়নি। এখন প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে নেতাজির ট্যাবলো বাদ দিয়ে এটাই প্রমাণ করছে আসলে বিজেপি নেতাজিকে ভয় পায়। যেমন ওদের ধর্মগুরু সাভারকর ভয় পেতেন।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.