বাবুল হক, মালদহ: নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে স্কুলের ক্লাসরুমে ঢুকে বন্দুকবাজকে জাপটে ধরে শতাধিক পড়ুয়ার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন যিনি, সেই আজহারউদ্দিন খানকেই সামনে পেয়ে ‘আপনারা কি পুতুল’ বলে কটাক্ষ করে ধমক দিলেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা। এই খান সাহেব রাজ্য পুলিশের কর্মী। মালদহের ডিএসপি তিনি। মাত্র প্রায় তিন মাস আগেই নিজের কর্তব্যপালন করতে গিয়ে পড়ুয়াদের রক্ষা করেছিলেন, মালদহবাসীর কাছে যিনি কার্যত ‘হিরো’ বনে গিয়েছিলেন, তিনিই কি না ‘পুতুল’! জাতীয় মহিলা কমিশনের এই ভর্ৎসনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সমালোচনার ঝড় ওঠে মালদহের বিভিন্ন মহলে। চরম ক্ষুব্ধ পুলিশ প্রশাসনের কর্তারাও।
মালদহের বামনগোলা থানার পাকুয়াহাটে গত ১৮ জুলাই চোর সন্দেহে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে মারধর করে উত্তেজিত কিছু মানুষ। এদিন সেই দুই মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মালদহের মানিকচকে পৌঁছন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন -সহ কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা। যথারীতি এদিনও কেন্দ্রীয় সরকারের মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ছিলেন মালদহের বিজেপি নেত্রী তথা ইংলিশবাজারের বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরি। কলকাতা থেকে বন্দেভারত এক্সপ্রেস ট্রেনে কমিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই মালদহে আসেন বিজেপি বিধায়ক শ্রীরূপা। মানিকচকে গিয়ে ওই দুই মহিলার সঙ্গে কথা বলার পর বিজেপি বিধায়কের সামনেই জেলা পুলিশের ডিএসপি (আইনশৃঙ্খলা) আজহারউদ্দিন খানকে প্রকাশ্যে ধমক দেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন বলে অভিযোগ। দেখা যায়, ডিএসপিকে সামনে পেয়ে মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা তাঁকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, “বামনগোলায় ‘নির্যাতিতা’ দুই মহিলাকেই গ্রেপ্তার করা হল কেন? কেন তাঁদের জেলে রাখা হল?”
উত্তরে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসনকে ডিএসপি আজহারউদ্দিন খান বলেন, “সোর্স ইনফরমেশন ছিল, ম্যাডাম। তবে ওই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। দোষ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ম্যাডাম।” তারপর ফের ভর্ৎসনা। এবার আজহারউদ্দিন খানকে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রশ্ন করেন,”আপনারা কি পুতুল? আপনারা তদন্ত করবেন না? ছ’দিন ধরে যখন ওই দুই মহিলা বন্দি ছিলেন তখনও আপনারা বুঝতে পারলেন না যে ভুল লোককে গ্রেপ্তার করেছেন? যিনি গ্রেপ্তার করেছিলেন তাঁকে গ্রেপ্তার করেছেন? ওই মহিলার জীবনে কি ছ’দিন ফেরত আসবে?’’ মালদহ পুলিশের ডিএসপি উত্তর দেন, ‘‘এই ঘটনায় কোনও গাফিলতি দেখলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব। যিনি গ্রেপ্তার করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। দোষ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
এই সেই পুলিশ কর্তা, যিনি গত ২৬ এপ্রিল মালদহেরই মুচিয়া চন্দ্রমোহন হাই স্কুলের ভরা ক্লাসঘরে ঢুকে পড়া এক বন্দুকবাজকে জাপটে ধরেছিলেন। ওই দিন সেই ক্লাসঘরে পড়ুয়াদের উদ্দেশে বন্দুক উঁচিয়ে শাসানি দিতে থাকে এক বন্দুকবাজ। সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ডিএসপি আজহারউদ্দিন খান। পিস্তল উঁচিয়ে থাকা ওই যুবককে পাকড়াও করেন তিনিই। আর তাঁকেই বামনগোলার ঘটনায় ধমক খেতে হল, শুনতে হল ‘পুতুল’! তৃণমূলের জেলার সহ-সভাপতি বাবলা সরকার বলেন, “দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুরে প্রাণহানি ঘটেই চলেছে। সেখানে আগুন জ্বলছে। মণিপুর নিয়ে কিছুই করছে না কেন্দ্রীয় সরকার। আর এখানে বিজেপি সোচ্চার হচ্ছে। বিজেপি নেত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কেন মহিলা কমিশন মালদহে? পুলিশকে ধমক দিচ্ছেন, অথচ বামনগোলার ঘটনায় পুলিশ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করেছে।”
এদিন সকালে মালদহ স্টেশনে নেমে নতুন সার্কিট হাউসে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মানিকচকে যান জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন-সহ প্রতিনিধিরা। দুই মহিলার সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। তাঁদের বয়ান সংগ্রহ করা হয়। পরে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসন রেখা শর্মা সাংবাদিকদের বলেন, “যাঁদের বিবস্ত্র করে মারধর করা হল, সেই দুই মহিলাকেই আবার অন্যায়ভাবে টানা ছয় দিন জেলে ভরে রাখা হল। জেলা পুলিশের কাছে আমরা জানতে চাই, কোন্ মামলায় তাঁদের ছয় দিন জেলে ভরে রাখা হয়েছিল। আমরা এই ঘটনা প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে জানাব।” এদিনই রাজ্য মহিলা কমিশনের এক প্রতিনিধিদল মানিকচকে গিয়ে ওই দুই ‘নির্যাতিতা’র সঙ্গে কথা বলেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.