ব্রতদীপ ভট্টাচার্য: অতি পরিচিত কেরোসিন, তার সঙ্গে কয়েক ছটাক পোড়া মোবিল। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এই ঘরোয়া টোটকাই হাতিয়ার উত্তর ২৪ পরগনার পঞ্চায়েতগুলির।
বর্ষা ঢুকতেই উত্তর ২৪ পরগনায় কামড় বসিয়েছে ডেঙ্গু। গত বছর শহরাঞ্চলে বেশি প্রকোপ দেখা গেলেও, চলতি বছরে গ্রামাঞ্চলেও ডানা মেলেছে মশাবাহিত এই রোগ। জেলার ছ’টি ব্লকে পরিস্থিতি রীতিমতো আশঙ্কাজনক। স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট বলছে, গোটা জেলায় ৫ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত এই রোগে। মৃতের সংখ্যা এগারো। জেলার পূর্ত কর্মাধক্ষ নারায়ণ গোস্বামীর যুক্তি, “ঘন জনবসতি পূর্ণ এলাকাতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যেত। এবার গ্রামেও তার প্রকোপ বিস্তার হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলেও জনসংখ্যা বাড়ছে।” আচমকা এই ডেঙ্গুর হানাদারি কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, তার পথ খুঁজতে এখন ব্যস্ত স্বাস্থ্য কর্তারা। আর সেই পথ খুঁজতে গিয়েই কেরোসিন তেল ও পোড়া মোবিল মিশ্রণের শরণ।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় নেমে অসুস্থদের চিকিৎসার পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের মূল চিন্তায় এখন ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার লার্ভা নিধন। এই কাজে ‘টেমফস’ জাতীয় তেলের ব্যবহারই প্রচলিত পদ্ধতি। কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে এই তেলের দাম। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “ডেঙ্গু প্রতিরোধক তেল টেমফস’-এর দাম রীতিমতো চড়া। প্রতি লিটারের দাম ১৫০০ টাকা। এবং এই বর্ষা বিদায়ের মুখে যেখানে প্রতিটি গ্রামেই খাল-বিল-পুকুর সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জলে ডুবে আছে, সেখানে তেলও চাই বিস্তর। স্বাভাবিকভাবেই বছরের মাঝপথে বিপুল পরিমাণ এহেন দামি তেল কিনে গ্রামের পর গ্রাম স্প্রে করার মতো সামর্থ্য অধিকাংশ পঞ্চায়েতেরই নেই। তাই বিকল্প হিসাবে স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশিকা অনুযায়ীই এই কেরোসিন ও পোড়া মোবিলের মিশ্রণের নিদান।” তাঁর কথায়, লার্ভা নিধনের কাজটা করবে মূলত কেরোসিন তেল। পোড়া মোবিলের ভূমিকা কেরোসিনের উদ্বায়ী চরিত্রে লাগাম টেনে তার স্থায়িত্ব বা আয়ু বাড়ানো।
উত্তর ২৪ পরগনায় এ মুহূর্তে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সব থেকে খারাপ হাবড়া—২ ব্লকে। সরকারি হিসাবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্লকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০। অক্টোবর মাসে তা একশো ছাড়িয়ে গিয়েছে। এছাড়া হাবড়া—১, গাইঘাটা, দেগঙ্গা, হাড়োয়া, বাদুড়িয়া ও স্বরূপনগরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গিয়েছে। পরিস্থিতির মোকাবিলায় মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে বৃহস্পতিবার হাবড়ায় জেলা পরিষদ সদস্য ও শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন জেলাশাসক অন্তরা আচার্য। বৈঠকে ছ’টি ব্লকে আরও ছ’টি মেডিক্যাল ক্যাম্প চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ক্যাম্পগুলিতে রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকছে। সেইসঙ্গে প্রতিটি পঞ্চায়েতকে পর্যাপ্ত পরিমাণ মশা মারার তেল, ব্লিচিং পাউডার কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়। গোল বেধেছে এখানেই! অধিকাংশ পঞ্চায়েতের বক্তব্য, মশা মারার তেলের প্রচুর দাম। তার উপর পঞ্চায়েতগুলির এলাকাও বিস্তীর্ণ। গোটা এলাকায় এত দামী তেল স্প্রে করার মতো সামর্থ্য সব পঞ্চায়েতের নেই। জেলা পরিষদ সূত্রে খবর, যে সমস্ত পঞ্চায়েত ‘টেমফোস’ কিনতে পারবে না, তাদের কেরোসিন ও পোড়া মোবিলের মিশ্রণ স্প্রে করতে বলা হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার উপ মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকারিক সুদীপ্ত ভাদুড়ি জানান, “স্বাস্থ্যদফতরের নির্দেশিকা অনুযায়ী মশার লার্ভা মারার জন্য টেমফোস—এর পরিবর্তে কেরোসিনও ব্যবহার করা যায়।”
এদিনের বৈঠক নিয়ে পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ জানিয়েছেন, “গ্রামাঞ্চলেও জনসংখ্যা বাড়ছে ও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে না। যে ছ’টি ব্লকে এবছর ডেঙ্গুর প্রভাব বেড়েছে তার প্রতে্যকটির চরিত্রই এরকম। তাই প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতকে নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি করতে বলা হয়েছে। এলাকা পরিষ্কার রাখার জন্য মাইকে প্রচার করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” এদিকে প্রশাসনের এই পোড়া মোবিল ও কেরোসিনের ‘টোটকা’ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, এতে দূষণ ছড়াতে পারে। যদিও সেই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্তারা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.