সৌরভ মাজি, বর্ধমান: প্রযুক্তি এগিয়েছে। অপরাধ দমনে তদন্তকারী সংস্থাগুলিও আধুনিক হয়েছে তাল মিলিয়ে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে তার থেকেও কয়েক কদম এগিয়ে থাকছে অপরাধজগতের লোকজন। এই কয়েক কদম এগিয়ে থাকাই অপরাধী ও অপরাধ দমনের মধ্যে যোজন দূরত্ব গড়ে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে ব্যাংক ডাকাতি-সহ কয়েকটি বড় অপরাধের তদন্তে এই ফারাকটা বড্ড প্রকট হয়েছে। কয়লা মাফিয়া রাজু ঝা হত্যাকাণ্ডেও অপরাধীদের পরিকল্পনা মাফিক আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তদন্তকারীদের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। আততায়ীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগে বিশেষ কলিং অ্যাপের সহায়তা নিয়ে থাকতে পারে। মোবাইল টাওয়ার ডাম্পিং বা কল ডিটেল রেকর্ড (সিডিআর) থেকে তদন্তকারীরা বিশেষ সুবিধা না পাওয়ায় তেমন সম্ভাবনাই উঠে আসছে।
সাইবার প্রযুক্তি উন্নয়নে পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ সহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা আধুনিক হয়েছে। বেশ কিছু খুন, ডাকাতি বা সাইবার প্রতারণার ঘটনার কিনারায় সাফল্যও এসেছে। সেক্ষেত্রে পুলিশের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ছিল মোবাইল নম্বর ট্র্যাকিং করা। কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গার মোবাইল টাওয়ারের অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আগে ও পরের একটা সময়ের মধ্যে কতগুলি মোবাইল থেকে ফোন করা হয়েছিল সেই তথ্য (ডাম্পিং) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তদন্তের কাছে। তার পর অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য পথের বিভিন্ন মোবাইল টাওয়ারের মোবাইলের ডাম্পিং সংগ্রহ করে অপরাধীদের সম্ভাব্য নম্বরটি চিহ্নিত করা হয়। সেই নম্বরের লোকেশন ট্র্যাক করে অপরাধীকে ধরা হয়। একইসঙ্গে তার মোবাইল নম্বরের কল ডিটেল রেকর্ডস (সিডিআর) সংগ্রহ করেন তদন্তকারীরা। তার ভিত্তিতে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত বাকিদেরও চিহ্নিত করতে পারেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ তথা বিভিন্ন তদন্তকারীদের এই পদ্ধতিতে ‘সাফল্য’ কুখ্যাত দুষ্কৃতীদের কাছে সাবধানবাণী হয়ে গিয়েছে। তাই মোবাইল নম্বরই আর ব্যবহার করছে না অপরাধজগতের লোকজন। সঙ্গে মোবাইল সেট থাকলেও তার মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করা বা ধরার কাজ করছে না তারা। এটা না করলে মোবাইল টাওয়ারে সেই নম্বরের কোনও ডাম্পিং হবে না। অর্থাৎ পুলিশ ওই নির্দিষ্ট জায়গায় মোবাইল টাওয়ার থেকে অপরাধীদের সম্ভাব্য মোবাইল নম্বর পাবে না। এখন অপরাধীরা নিজেদের মধ্য যোগাযোগ রাখতে ‘অত্যাধুনিক কলিং অ্যাপ’-এর সাহায্য নিচ্ছে। যা এখনও সর্বসাধারণ তো বটেই সাইবার অপরাধ দমনে যুক্তদের কাছেও হয়তো অপরিচিত। এই সব অ্যাপের মাধ্যমে কথাবার্তা হলে তা ট্র্যাক করা কার্যত অসম্ভবের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তদন্তকারীদের কাছে।
গত শনিবার পূর্ব বর্ধমানের শক্তিগড়ের কাছে খুন হয়েছিলেন রাজু ঝা। আততায়ীরা একটি নীল গাড়িতে করে এসে গুলি করে খুন করে রাজুকে। গাড়িতে থাকা রাজুর সঙ্গী ব্রতীন মুখোপাধ্যায়ের হাতে গুলি লেগেছিল। গাড়িতে গরুপাচার মামলায় সিবিআইয়ের খাতায় ফেরার আবদুল লতিফও ছিল। গাড়িটিও লতিফেরই। ঘটনার পর অবশ্য লতিফ গা ঢাকা দিয়েছিল। সেদিন লতিফকে ফোনে কথা বলতেও দেখা গিয়েছে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে। লতিফ সাধারণ কলিং অর্থাৎ মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে থাকলে সিবিআইয়ের পক্ষে তার নাগাল পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আবার রাজুর আততায়ীরা ‘বড় মাথার’ নির্দেশ মত সুপরিকল্পিতভাবে অপারেশন চালিয়েছিল। তারাও সেই মাথার সঙ্গে অবশ্যই নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিল। ফলে শক্তিগড় সহ অন্যান্য জায়গার টাওয়ার ডাম্পিং থেকে পুলিশের পক্ষে তাদের সম্ভাব্য মোবাইল নম্বর চিহ্নিত করা সহজ হত। দ্রুত অপরাধীকেও চিহ্নিত করতে পারত পুলিশ। সূত্রের খবর এক্ষেত্রে তেমন কোনও ‘সুরাগ’ তদন্তকারীরা পাননি। পেলেও সেটিকে ট্র্যাক করে এখনও অপরাধীদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।
এর থেকে অনুমান করা হচ্ছে, বিশেষ কোনও কলিং অ্যাপের মাধ্যমে আততায়ীরা মাস্টামাইন্ড বা সুপারি নেওয়া লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল। যার ফলে তদন্তকারীরা এখনও টিকি ধরতে পারেনি তাদের। এছাড়াও বড় মাপের অপরাধীরা আইফোন ব্যবহার করে। যার মাধ্যমেও বিশেষ কল করা না কি সম্ভব। তার রেকর্ড পাওয়াটাও পুলিশের কাছে দুরূহ ব্যাপার। সময়সাপেক্ষও। অপরাধীরা আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগালেও হাল ছাড়ছে না পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ। সাইবার অপরাধ দমনে জেলা পুলিশের সেলের দক্ষ অফিসারদের উপর বিশেষ আস্থা রাখছে এই খুনের কিনারায় গঠিত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট)। সাইবার প্রযুক্তিতে দক্ষ পুলিশ আধিকারিকরাও সিটকে ফলপ্রসূ কোনও লিঙ্ক তুলে দিতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। রাজু খুনের কিনারায় পুলিশের সাইবার শাখাই হয়তো তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.