টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: কখনও স্থানীয় বাসিন্দাদের তাড়া, তো আবার কখনও পুলিশের উদাসীনতা। তাড়া খেয়ে পালাতে হচ্ছে, উদাসীনতায় ফিরে যেতে হচ্ছে উলটো পথে। দিনের বেলায় তাই ঠাঁই হচ্ছে স্থানীয় জঙ্গলে, রাত কাটছে রেল ব্রিজের নিচে। এভাবেই সহায় সম্বলহীন হয়ে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার সীমানায় চরম দুর্দশায় দিন কাটছে বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে কাজ করতে আসা ৪০ জন পরিযায়ী শ্রমিকের। পরবাসে এমন দুর্দশা কবে কাটবে, সেই দিনই গুনছেন তাঁরা।
এ যেন লক ডাউনের পর দিল্লির সেই আনন্দ বিহার বাসস্ট্যান্ডের খণ্ডচিত্র যেন। সংখ্যাটা সবমিলিয়ে চল্লিশ জন। এঁরা সকলেই বিহারের মুঙ্গের ও ঝাড়খণ্ড থেকে কাজের জন্য এ রাজ্যে এসেছিলেন। কেউ এসেছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায় আলুর হিমঘরে কাজ করতে, তো কেউ কাজ করতেন হাওড়ার কোনও ছোট কারখানায়। সকলেই মুটে মজুরি করে দিন কাটাতেন। দিব্যি চলছিল কাজকর্ম। হঠাৎ আচমকা ‘লকডাউন’-এর খাঁড়া নেমে এল মাথার উপর। বন্ধ হয়ে গেল পরিবহণ, দিন মজুরি করে আয়ের রাস্তাও আর রইল না।
অর্থ আর আশ্রয়ের অভাবের কথা ভেবে মাথায় ভারি পোঁটলা বেঁধে হাঁটা শুরু করলেন বাড়ির দিকে। লকডাউনের মাঝে রাস্তা বলতে রেললাইন। সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা পেরিয়ে গেলেন প্রায় দু’শো কিলোমিটার। পৌঁছলেন পুরুলিয়ার আদ্রার কাছে। সেখানেই ঘটে গেল অঘটন। পুরুলিয়া জেলা পুলিশ তাঁদের আর এগোতে দিতে নারাজ। অথচ সামান্য আশ্রয়টুকুও মিলল না। অভিযোগ, ফেলে আসা রেলপথ ধরেই তাঁদের উলটো দিকে অর্থাৎ ফিরিয়ে দেওয়া হয় বাঁকুড়ার দিকে। অগত্যা আরও কয়েক ক্রোশ পথ পিছিয়ে এসে পরিযায়ী শ্রমিকদের দল থামল বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার সীমানায় থাকা ডাংরা নদীর রেল সেতুতে।
এঁদের দায়িত্ব কে নেবে, দুই জেলার টানাপোড়েনে আপাতত সেখানেই চারদিন ধরে আটকে রয়েছে চল্লিশ জন পরিযায়ী শ্রমিক। না আছে মাথার উপর ছাদ, না খাবারের ব্যবস্থা। স্থানীয়রাও সেভাবে এগিয়ে আসেননি বলে অভিযোগ। বরং রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় তাঁরাও তাড়া করে বেরিয়েছেন এই পরিযায়ী শ্রমিকদের। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো শক্তি আর নেই, এখন আত্মগোপনই একমাত্র অস্ত্র এঁদের। পেটে খিদের আগুন জ্বলছে, তা নেভাতে নদীর জলই ভরসা। স্থানীয় কোনও কর্তব্যপ্রবণ মানুষ হাত বাড়ালে তবেই খাবারের স্বাদটুকু পাচ্ছেন। গত চারটে দিন এভাবেই কেটেছে। এখন ঘরে ফিরতে চান ওই শ্রমিকরা। ফিরতে চান নিজেদের পরিবারের কাছে। আর যতদিন না তা হচ্ছে, তাহলে অন্তত একটা আশ্রয় আর দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের নিশ্চয়তা দিক কেউ। রোগ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে লকডাউনের সিদ্ধান্ত এমনই ‘অভিশাপ’ হয়ে নেমে এসেছে তাঁদের জীবনে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.