Advertisement
Advertisement

রূপনারায়ণের তীরে ইতিহাস আগলাচ্ছেন শরৎচন্দ্রের সেবাইত

সঙ্গী ময়ূরের খাঁচা, চিত্তরঞ্জন দাশের রাধাকৃষ্ণ, আর সব্যসাচী।

Meet Dulal Manna, who takes care of Sarat Chandra Chattopadhyay's deulti house
Published by: Suparna Majumder
  • Posted:August 8, 2018 12:12 pm
  • Updated:August 8, 2018 12:52 pm  

ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: সত্তরটার বেশি বসন্ত দেউলটির এই বাড়ির দালানেই পার করে ফেলেছেন দুলাল মান্না। কিন্তু, আর কত কাল?

এ বাড়ির নির্মাতা প্রয়াত হয়েছেন বহুদিন। রয়ে গিয়েছে তাঁর স্মৃতি। যার সঙ্গে জড়িয়ে বাংলার ইতিহাসের একটা বড় অধ্যায়। সেই স্মৃতি, সেই ইতিহাসকে চল্লিশ বছর ধরে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন মানুষটা।

Advertisement

এ বাড়ির কেয়ারটেকার। এ বাড়িতে আসা দর্শনার্থীদের গাইডও বটে। যদিও তাঁর নিজের ভাষায় তিনি ‘সেবাইত’ মাত্র!

বার্মায় কর্মজীবন শেষ করে এসে হাওড়ার দেউলটিতে রূপনারায়ণ নদের তীরে শখ করে বর্মিজ ধাঁচে বসতবাটি বানিয়েছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এখানেই তাঁর জীবনের শেষ দশ বছর কাটে। তারও দশ বছর পর জন্ম দুলালবাবুর। যৌবনে এ বাড়িতে পা রাখা। সেদিন থেকে আজও এ বাড়িই তাঁর তীর্থক্ষেত্র। কর্মক্ষেত্রও বটে।

কালের নিয়মে সরে গিয়েছে রূপনারায়ণ। দোতলার চকমিলানো বারান্দায় দাঁড়ালেই আজ কেবল তার দেখা মেলে। রোজ একবার সেই বারান্দায় দাঁড়ানোটা দুলালবাবুর রুটিন কাজ। যেমন রুটিন গড়গড়া, ভালভ রেডিও, শতাব্দীপ্রাচীন জলচৌকি, লেখার টেবিলের গায় হাত বোলানো। ঝাড়পোঁছ করে সেসব চকচকে রাখা।

এ বাড়ির আসবাব, কারুকাজ নিয়ে বৃদ্ধের অহংকারের শেষ নেই। ঘরের কোনায় যত্ন করে কাটা দেওয়ালের পন, ইলেকট্রিক লাইনের ব্র‌্যাকেট, মৃদু হলদে আলো- সব যেন তাঁর কথারই বাধ্য। কবে কোন বই লেখক লিখেছিলেন, কোন গোপন বৈঠকে কোন উপন্যাসের পটভূমি তৈরি হয়েছিল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু-চিত্তরঞ্জন দাশেরা কোন ঘরে বসে বৈঠক করতেন, এমনকী, তাঁর রাধাকৃষ্ণের পুজোর ভার চিত্তরঞ্জন দাশ কবে শরৎচন্দ্রের উপর দিয়ে যান- রোজ ইতিহাসের সেসব পাতা অনর্গল উলটে যেতে পারেন বৃদ্ধ দুলাল।

লাল রঙের পাঁচিলে ঘেরা গাঢ় সবুজ বাগান। তারই মাঝে দোতলা মাটির বাড়ি। সদরের ছোট্ট কাঠের দরজা খুলতেই বাঁধানো পায়ে হাঁটা পথ গিয়ে উঠেছে বাড়ির দাওয়ায়। কেয়ারি করা বাগান, জোড়া ময়ূরের খাঁচা, উপরে খরগোশের ঘর, ছোট টালি বসানো কড়ি-বড়গার চাল, বার্মার টিক সেগুনের আসবাব- বাড়ি বেশ যত্ন করেই বানিয়েছিলেন লেখক। পাড়া-পড়শির কথায়, এমন ঐতিহ্যশালী বাড়ি বা বাড়ির মালিক সম্পর্কে দুলালবাবুর মতো আর জানেন না কেউই।

[পাইন আর ধুপি গাছের জংলি পথে হারাতে পা বাড়ান লামাদের ঘর লামাহাট্টায়]

দাওয়ার কাছে পা রাখতেই হেলানো কাঠের একটা গুঁড়ি। “ওটা রামের সুমতির পেয়ারা গাছের গুঁড়িটা। বাড়ির সামনে পুকুরটা দেখলেন? কার্তিক-গণেশকে মনে আছে? ওই পুকুরেই তারা ছিল।”- নাগাড়ে বলে চলেন বৃদ্ধ।

“সব্যসাচীকে মনে আছে?”- বলে চলেন, “সব্যসাচী মানে কী? যিনি দু’হাতে সমানে বন্দুক চালাতে পারেন। দু’হাতে সমান বন্দুক চালাতে পারতেন কে? রাসবিহারী বসু। তাঁকে দেখেই তো ‘পথের দাবী’ লেখা। সে তো এ বাড়িরই গল্প। কালজয়ী সব গল্প-উপন্যাস।” একতলার ছোট ঘরটায় ঢোকেন দুলালবাবু। “নদীর দিকে এই ঘরই ছিল লেখকের সবচেয়ে পছন্দের। জানলাটা খুলে দিলেই নদী। ওদিকে মুখ করেই বসতেন।”– আউড়ে যান কোমরে হাত রেখে।

চেহারা ইর্ষণীয় না হলেও বেশভূষায় পারিপাট্য যথেষ্ট। পরনে কাচা পরিষ্কার লুঙ্গি। উপরে হাত গোটানো সাদা শার্ট। চুলের সংখ্যা অল্প হলেও গোছানো। চোখের পাশের চামড়া হার মেনেছে বহুকাল। টুকটাক লোডশেডিং এ বাড়ির সঙ্গী। তা না হলে কাচের দেরাজে রাখা অ্যানুয়াল রেজিস্টার, ‘হিস্ট্রি অফ হিউম্যান ম্যারেজ’, ‘স্ট্যান্ডার্ড ডিকশনারি’, ‘স্টাডিজ অ্যান্ড সাইকোলজি অফ সেক্স’ ইত্যাদি নিয়ে লেখকের পাণ্ডিত্য প্রমাণের চেষ্টার ত্রুটি করতেন না দুলাল। “এসব না পড়লে চরিত্রহীন লিখতেন কী করে?”- অন্ধকারেই বলে উঠলেন বৃদ্ধ।

দোতলায় শরৎবাবু আর তাঁর ভাইয়ের শোয়ার ঘর। চারপাশের বারান্দায় সিমেন্টের রঙিন মেঝে দেখলে এখনকার বাহারি দামি ‘ভেট্রিফায়েড টাইলস’-ও ইর্ষা করবে। সেখানে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আজও অতীতের শব্দ শোনেন অনুগত সেবাইত। সব শেষে গুগলের উপর খবরদারি চালাতেও ভোলেন না। “পরেরবার এলে মনে রাখবেন, সন্ধ্যা ছ’টায় এ বাড়ি বন্ধ। নেট দেখে আসবেন না। সেখানে পাঁচটা লেখা আছে।” ভুল ধরিয়ে অন্ধকার ঘরে মিলিয়ে যান শরৎচন্দ্রের গাইড।

কিন্তু, আর কত কাল? এর পর কার হাতে যাবে এ বাড়ির দায়িত্ব?

[কনকনে বাতাস আর নরম আলোর সাম্রাজ্যে ভ্রমণপিপাসুদের স্বাগত জানাতে তৈরি ‘উত্তরে’]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement