বিশ্বদীপ দে: উৎসব একসময় শেষ হয়ই। তবু সমাপ্তির করুণ সুরে লেগে থাকে ফিরে আসার আশ্বাস। বিজয়া দশমীর (Vijaya Dashami) মধ্যে যতই বিষাদ-স্পর্শ থাক, শেষ পর্যন্ত ‘আসছে বছর আবার হবে’র আশ্বাস হয়ে ছড়িয়ে থাকে মনে। কিন্তু যে ‘প্রতিমা’ আর ফিরে আসে না? এক বঙ্গকন্যার অকালবিদায়ের সুরের সঙ্গে মিশে রয়েছে এমনই এক বিজয়ার করুণ আখ্যান। ইতিহাস হয়েও আজকের স্বার্থান্বেষী ক্ষতবিক্ষত সময়ের বুকে তা এক রূপকথার আলো ছড়ায়।
দেশের প্রথম শহিদ কন্যাকে আমরা চিনি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (Pritilata Waddedar) নামে। কিন্তু মাস্টারদা সূর্য সেনের (Surya Sen) কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ‘রানি’ নামেই। গত শতকের তিনের দশকে যখন পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের মূল নেত্রী প্রীতিলতা পুলিশের কাছে ধরা না দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন তখন পুজো আসতে আর সামান্য ক’টা দিনই বাকি। তাঁর মৃত্যুর ১৫ দিনের মাথায় এসেছিল সেবছরের বিজয়া। মৃণ্ময়ী প্রতিমার বিদায়ক্ষণ তাই মাস্টারদার মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলছিল ‘বোন’ রানির কথা।
সে এক উত্তাল সময়। অগ্নিযুগ। দেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীর বুকের মধ্যে পরাধীনতার জ্বালা যে অগ্নিশিখার জন্ম দিয়েছিল তা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল ব্রিটিশ সরকারকে। সেই যুগেরই দুই অমোঘ প্রতিনিধি সূর্য সেন ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। মাস্টারদা সেই সময় পলাতক। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের (Chattagram Astragar Lunthan) পর বছর তিনেক পেরিয়েছে। দিকে দিকে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ব্রিটিশ পুলিশ। কিছুদিন আগেই ধলঘাটে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচেছেন। ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের মৃত্যু হলেও হারাতে হয়েছে দুই বিশ্বস্ত অনুচরকে। বর্ষার রাতে ঘন জঙ্গল আর জলাভূমির মধ্যে বুকে হেঁটে সেদিন প্রায় চার মাইল পথ পেরতে হয়েছিল সূর্য সেনকে। সঙ্গী ছিল প্রীতিলতা।
মৃত্যুকে সেদিন একেবারে সামনে থেকে দেখেছিলেন ২১ বছরের তরুণী। কিন্তু মৃত্যুভয়কে নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত থাকলে কি আর দেশকে স্বাধীন করতে নিজেকে অনির্দেশ্য অন্ধকারের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া সম্ভব? বলা যায়, ব্যাপারটা ছিল ঠিক উলটো। মাস্টারদা চাননি তাঁর রানি কোনও অ্যাকশনে যান। কিন্তু প্রীতিলতাই জেদ ধরে বসেছিলেন। ধরা পড়ার আগে পটাশিয়াম সায়ানাইড শরীরে চালান করে দিয়েছিলেন। আর সঙ্গে রেখে দিয়েছিলেন এক সুইসাইড নোট। তিনি তো জানতেন ফিরে আসার পথ নেই। তাই চিরবিদায়ের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি করে গিয়েছিলেন শেষ বিদায়ের বাণী। সেখানে তিনি পরিষ্কার লিখেছিলেন, ”দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না?”
তাঁর এই সংকল্প, দৃঢ়চেতা মনোভাবের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছিল তাঁর মাস্টারদাকে। পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের প্রধান নেত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন প্রীতিলতা। জগৎবন্ধু ওয়াদ্দেদারের বড় মেয়ে, নন্দনকানন অপর্ণাচরণ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সেদিন উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এমন সুযোগ পেয়ে। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মালকোঁচা দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতো পরে ছদ্মবেশের আড়াল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রাতের অন্ধকারে। সঙ্গে কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী, মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন। দিনটা ছিল শনিবার। ক্লাবঘরে প্রায় জনা চল্লিশেক মানুষ। ইংরেজদের আর পাঁচটা ক্লাবের মতো এই ক্লাবের বাইরেও লেখা ছিল ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’!
সেদিন পানোল্লাসে মত্ত ইংরেজদের কানের ভিতরে বেজে উঠেছিল গুলি ও বোমার তীব্র শব্দ। দ্রুত বন্দুকের গুলিতে নিভে যায় সমস্ত আলো। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসারের কাছেও অবশ্য বন্দুক ছিল। শুরু হয়েছিল গুলি-পালটা গুলির লড়াই। শেষ পর্যন্ত গুলিতে আহত হন প্রীতিলতা। পরে তাঁর সতীর্থরা পালিয়ে গেলেও আহত ও রক্তাক্ত প্রীতিলতা গলায় ঢেলে দেন পটাশিয়াম সায়ানাইড। মুহূর্তে থমকে যায় শরীরের রক্তপ্রবাহ। ঘটনার পরদিন ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূর থেকে উদ্ধার হয়েছিল তাঁর মৃতদেহ।
এর ঠিক পনেরো দিন পরে ছিল বিজয়া। সেদিন সূর্য সেন লিখতে শুরু করেন এক করুণ আখ্যান। সেই লেখা এত বছর পরেও পড়তে শুরু করলে মনে হয় যেন সদ্য লেখা হয়েছে- এমনই জীবন্ত সেই শব্দ ও বাক্যগুলি। মাস্টারদা লিখছেন, ”পনের দিন আগে যে নিখুঁত পবিত্র, সুন্দর প্রতিমাটিকে এক হাতে আয়ুধ, অন্য হাতে অমৃত দিয়ে বিসর্জ্জন দিয়ে এসেছিলাম, তার কথাই আজ সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে।… সাজিয়ে দিয়ে যখন করুণভাবে বললাম, ‘তোকে এই শেষ সাজিয়ে দিলাম। তোর দাদা তো তোকে আর জীবনে কোনোদিন সাজাবে না’, তখন প্রতিমা একটু হেসেছিল। কী করুণ সে হাসিটুকু! কত আনন্দের, কত বিষাদের, কত অভিমানের কথাই তার মধ্যে ছিল।”
আরেকটু পরেই লেখা, ”… মরজগতে আমরা তার বিসর্জনের ব্যথা যে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আজ বিজয়ার দিনে, সেদিনের বিজয়ার করুণ স্মৃতি যে মর্মে মর্মে কান্নার সুর তুলছে- চোখের জল যে কিছুতেই রোধ করতে পারছি না- চাপিতে গেলে উঠে দু’কুল ছাপিয়া।” লেখার একেবারে শেষে তাঁর প্রার্থনা, ”বরদাত্রী মা আমার- আমায় আশীর্বাদ করো যেন আমার স্নেহের প্রতিমার মধ্যে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মহৎ দেখেছি, তা যেন আমার এবং আমার প্রিয় ভাইবোনেরা জীবনে প্রতিফলিত করবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি না করে।”
প্রীতিলতার মৃত্যুর পরে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ধরা পড়ে যান ইংরেজ সরকারের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সূর্য সেন। সেই সময়ই পুলিশ হাতে পায় একটি খাতা। সেই খাতার শিরোনাম ছিল ‘বিজয়া’। বিচারের সময় ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেই অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনী।
তারপর কেটে গিয়েছে দশকের পর দশক। প্রীতিলতা-সূর্য সেনদের আমরা হারিয়েছি কবেই। তবু আজও মাস্টারদার কলম ছুঁয়ে সেই হারানো সময় যেন মুহূর্তে ফিরে ফিরে আসে। কত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, আত্মত্যাগের মাইলফলক পেরিয়ে আমরা পৌঁছেছি স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু মনে রাখতে পেরেছি কি সেদিনের সেই বিজয়াকে? যেদিন প্রিয় সদ্যমৃত বোনটির করুণ হাসির সুর বিষণ্ণতায় ঢেকে দিয়েছিল সূর্য সেনের মন। এত বছর পরেও সেই বিষাদ ছুঁয়ে যায় আমাদের। সেই সঙ্গে গর্বেও ঢেকে যেতে থাকে মনের চরাচর। স্বাধীনতার মূল্য নতুন করে বুঝতে শেখায় ফেসে আসা এক বিজয়ার করুণ সুর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.