কৃষ্ণকুমার দাস: ২০২০ সালের ২০ মে। ‘বিষে বিষে, বিষক্ষয়’ হয় শুনেছি। কিন্তু তিন বিশ পাশাপাশি থাকলে যে এতটা ক্ষমতাশালী প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড় হতে পারে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কলকাতাবাসী। মারণ কোভিড-১৯-এর সঙ্গে প্রকৃতির লীলাখেলায় প্রত্যক্ষ করলাম আরেকটি ভয়ংকর মহাদুর্যোগ।
টানা ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে অত্যাচার চালিয়ে তিলোত্তমার শরীরে অসংখ্য গভীর ক্ষত চিহ্ন রেখে গেল বুধবার।
মঙ্গলে উষা বুধে পা। জ্যোতিষ গণনায় যতই শুভ বলা হোক না কেন, অন্তত ২০ মে, ২০২০ বুধবার কলকাতাবাসীর কাছে শুভ ও সুখকর রইল না। আপাতত কলকাতার বুকে হাওয়া অফিসের হিসাবে সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ভারী বৃষ্টিতে ভাসল মহানগরী। শুধু কয়েক লক্ষ গাছ ভেঙে পড়া নয়, প্লাবিত হয়েছে হাওড়া, হুগলি, দুই ২৪ পরগনার বহু নিচু জনপদ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দমদম বিমানবন্দরের ফাইবার গেটও। মধ্যরাত পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন মহানগরে ভেসে এসেছে শুধু ঝড়ের সো-সো শব্দ, জলের ঝাপটানি। লণ্ডঙণ্ড শহরের রাস্তাঘাট কার্যত শুধু আচল বা গাছপালায় ভরতি হয়নি, জলেও ডুবে ছিল। যাঁরা জরুরি বিভাগে চাকরি করেন তাঁরা অনেকেই বাড়ি ফিরলেও ছিড়ে পড়া তার-গাছ ও জমা জলের দাপটে ঘরে ঢুকতে পারেনি। সহজ কথায়, চেনা শহরটা পুরোপুরি খন্ডহর করে মধ্যরাতে শক্তিক্ষয় করে বাংলাদেশের দিকে রওনা দেয় সুপার সাইক্লোন। জব চার্ণকের হাত ধরে শহর পত্তনের পর জীবিত কেউ
তো দেখেননি, এমনকী কলেজ স্ট্রিট পাড়ার কোনও বইতেও বাংলার রাজধানীতে ঘূর্ণিঝড়ের এমন ভয়াবহ ধ্বংসলীলার তথ্য কেউ কোনওদিন লিখে রাখেননি।
অবিশ্বাস্য গতির ভয়ংকর ঝড় থামার পর রাতে শহরজুড়ে প্রশ্ন, সামনে আর কী কী দুর্যোগ আসতে পারে? কারণ, এক বছরের মধ্যেই দুই ঝড় বুলবুল-ফণীর পর থাইল্যান্ডবাসীর নামকরণ করা সুপার সাইক্লোন কার্যত দুরমুশ করে দিয়ে গেল কলকাতাকে।
তাঁর নাম আমফান না উম-পুন তা নিয়ে অনেক রঙ্গ-রসিকতা করছিলেন। সকালে বন্ধু-বান্ধবীকে অনেকে হোয়াটসঅ্যাপে গুড মর্নিংয়ে আমের ছবি দিয়ে ‘আম-ফান’ পাঠিয়েছেন। কখন ঠিক আসবে, কোনদিকে দিয়ে আসবে? কেউ আবার রসিকতা করে বলছিলেন, বাংলাদেশ বা ওড়িশা ঠিক ঝড়টা টেনে নেবে। কলকাতায় কী সত্যিই ১৩০ কিমি বেগে ঝড় আদৌ আসবে? কেউ কেউ আবার আলিপুর আবহাওয়া অফিসের অধিকর্তা রাজেন গোলদারের নাম তুলে ঝড়ের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে তীর্যক কটাক্ষও করেন। কিন্তু রাতে আবহাওয়া দপ্তরের দমদম পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের রিপোর্ট, ১৩০ নয়, কলকাতার উপর দিয়ে সন্ধ্যায় ঝড় ১৩৩ কিমি প্রতি ঘণ্টায় চলে গিয়েছে শুনে অনেকেই কার্যত বাক্যহারা হয়েছেন।
আবহাওয়া অফিসের কড়াবার্তা পেয়ে নবান্নের নির্দেশে মঙ্গলবার রাত থেকে কলকাতা পুলিশ পাড়ার গলিতে গলিতে গিয়ে ঘরে থাকার বার্তা পৌছে দেয়। কিছু এলাকায় দু’একটা দোকান-বাজার খুললেও পুলিশ গিয়ে তা সাত সকালেই বন্ধ করে দেয়। অতিবড় নিন্দুকেরাও রাতে স্বীকার করেছেন, নবান্নের নির্দেশে সুপার লকডাউন কার্যকর করায় কলকাতায় বড়মাপের প্রাণহানি এড়ানো গিয়েছে। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বিকেল তিনটে থেকে বিদ্যুৎ বন্ধ এবং ঝড় না থামা পর্যন্ত উদ্ধার কাজ স্থগিত রাখায় দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে বলে স্বীকার করেছেন পুলিশ ও পুরসভার শীর্ষকর্তারা। তবে যে পরিমাণে কলকাতা, হাওড়া ও দুই ২৪ পরগনায় গাছ ভেঙেছে, লাইটপোস্ট উপড়ে পড়ছে, গৃহস্থের জলের ট্যাঙ্ক পড়েছে এবং বিদ্যুৎ কাঠামো বিকল হয়েছে তাতে জনজীবন ও পরিষেবা স্বাভাবিক হতে বেশ কয়েকদিন লাগবে। বহু মানুষের বাড়ির বাইরের এয়ারকন্ডিশন মেশিনের অংশ থেকে শুরু করে ছাদের ফুলের টব, দোকানের সাইনবোর্ড উড়ে চলে গিয়েছে। উধাও হয়ে গিয়েছে বাড়ির ছাদে বসানো টিভির ডিস-এ্যান্টেনা। ছিঁড়ে গিয়েছে কেবল টিভির চার। তাই বিদ্যুৎ থাকলেও টিভি বন্ধ। ঝড়ের সময় রাস্তা দূরের কথা, ব্যালকনিতেও কেউ আসবেন বা বলে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়ায় কৌতূহল আরও বেড়েছিল শহরের। রীতিমতো ভোট গনণার মতো কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছিল। সবাই বারে বারে খবর নিচ্চিলেন, ঠিক
কটায় কলকাতায় ঢুকবে আমফান। যেন সেই থাইল্যান্ডবাসীর কাছ থেকে নাম নিয়ে আসা অপরিচিতার সঙ্গে কোলাকুলি করবে।
তবে দুপুর গড়াতেই সেই কৌতূহল ক্রমেই আতঙ্কের চেহারা হয়ে ধরা দেয় গোটা মহানগর ও শহরতলীতে। কারণ, ততক্ষণে টিভিতে ওড়িশা ও দিঘায় আমফান ঢুকে তাণ্ডবের ছবি আসতে শুরু করে দিয়েছে। বকখালি, হিঙ্গলগঞ্জ ও দিঘায় জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা দেখে আতঙ্ক বাড়তে থাকে। বিকেল তিনটের পর থেকে ঝড়ের পাশাপাশি প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়। গাছ পড়তে থাকে নিউ আলিপুর, নিউমার্কেট, গড়িয়াহাট, ওয়েলিনটন, চাঁদনিচক, সল্টলেক সর্বত্র। হোর্ডিং উড়তে থাকে
এলোমেলো। অনেক বাড়ির টিন উড়ে গিয়ে শহরের রাস্তায় পড়েছে। উড়ে গিয়েছে বস্তিবাসীর সংসারের জিনিসপত্র ও বই খাতা পত্র। নিউমার্কেটে দোকানের ঘর উড়ে যায়। একের পর এক গাড়ি চাপা পড়তে থাকে বড় বড় গাছ ভেঙে। সন্ধ্যায় ভরা জোয়ার আসায় জমা জল নামতে দেরি হয়। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। কসবা, তিলজলা থেকে উত্তর কলকাতা, বহু এলাকায় বাড়ির মধ্যে জল ঢুকে যায়।
পুরসভার রিপোর্ট, শহরের অন্তত ১০০ ওয়ার্ডে জল জমেছে। তবে রাতভর পাম্প চালিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় বলে নিকাশী বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা জানিয়েছেন। যাদবপুর, বেলেঘাটা, বেহালা, ঠাকুরপুকুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায়। তবে রাতে ঝড় থামার পর পুরসভা ও পুলিশ উদ্ধারকাজ শুরু করেছে। নেমেছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। সক্রিয় হয়েছে সিইএসসি। পুরসভা যাদের বিপজ্জনক বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাদের মাস্ক দেওয়া হয়েছে। কারণ, এর মধ্যেও করোনা সংক্রমণ রুখতে হবে। আপাতত করোনা সরিয়ে আগামী কয়েকদিন কলকাতাবাসীর মুখ্য আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল, আমফানের তান্ডবে তছনছ হয়ে যাওয়া তিলোত্তমার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব-নিকেশ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.