বিক্রম রায়, কোচবিহার: কখনও ফেলে দেওয়া কলার খোসাই ধুয়ে খেয়েছেন। আবার কখনও স্রেফ বাদামের খোসা চিবিয়েই পেট ভরাতে হয়েছে। একরাশ আতঙ্ক বুকে নিয়ে সুড়ঙ্গের অতলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থমকে থাকা প্রতিটি দিনই যেন তখন দুঃস্বপ্ন! বেঁচে ফেরার আশাই যখন প্রায় দুরাশা, তখনই টানা সতেরো দিনের মাথায় বদ্ধ সুড়ঙ্গ থেকে মুক্তি পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন চল্লিশের কোঠার মানিক তালুকদার। আর তার ঠিক তিনদিনের মাথায় এ যেন তাঁর নবজন্ম!
কোচবিহারের (Cooch Behar) যে মাটিতে আশৈশব বেড়ে ওঠা, বলরামপুরের সেই চাকাডেরা গেন্দারপারেই শুক্রবার মানিকের পা পড়ল সম্পূর্ণ অন্য আবহে। অনেকদিনের চেনা সেই মানুষটাকেই ঢাকঢোলের জগঝম্প আর উলু-শঙ্খে নতুন করে বরণ করে নিতে ভেঙে পড়ল গোটা গ্রাম। ঘনঘন উড়ে এল ফুল, মালা। মিষ্টিমুখের উচ্ছ্বাস চারিয়ে গেল তল্লাটময়। দীর্ঘ অনিশ্চয়তা কাটিয়ে অবশেষে স্বজনদের পরশ পেয়ে উচ্ছ্বাসে আকণ্ঠ ভাসলেন মানিক নিজেও। রীতিমতো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন ঘরে ফেরার আনন্দ।
কেমন ছিল সুড়ঙ্গে বন্দি সেই সব দিন? কীভাবে কাটত আশঙ্কাময় দিন-রাত? দুঃস্বপ্নের সেই দিনগুলিই এদিন ঘরে বসে ফিরে দেখছিলেন মানিক তালুকদার। বলছিলেন, একটানা ১৮ ঘণ্টা সবরকম যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। সহায় বলতে ছিল বিদ্যুৎ সংযোগ এবং পানীয় জল। অবশেষে যখন প্রশাসন যোগাযোগ করতে পারল, তখন সকলেরই মনে আশা জাগল, এবার হয়তো বেঁচে যাব! তারপর শুরু হল অপেক্ষা। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। মানিকের কথায়, ‘‘নিজেদের শান্ত রাখতে একসঙ্গে বসে গল্প করতাম। কাগজ ছিঁড়ে চোর-পুলিশ খেলা থেকে শুরু করে পাথর দিয়ে ১৬ ঘুঁটি খেলেও সময় কাটিয়েছি।’’
উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে যে ৪১ জন শ্রমিক আটকেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন কোচবিহারের মানিক তালুকদার। শুক্রবার বিকেলে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে দিল্লি থেকে বিমানে শিলিগুড়ির বাগডোগরায় পৌঁছন মানিক। সেখান থেকে গাড়িতে ব্লক প্রশাসন ও বলরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিক্রম অধিকারী তাঁকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সুড়ঙ্গে আটকে পড়ার স্মৃতি এখনও তাঁর মনে দগদগে, ‘‘সুড়ঙ্গের ভিতরে তখন কাজ চলছিল। হঠাৎ করে কয়েকজন বলেন, একদিকে ধস নেমেছে। কয়েকজনের বেরিয়ে যাবার সুযোগ ছিল। তবে সকলের কথা মাথায় রেখেই আমরা কেউ বের হওয়ার চেষ্টাই করিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে ধস এত গুরুতর হয়ে পড়ে যে আর বেরনোর কোনও সুযোগই ছিল না।’’
মানিক বলছিলেন, মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ এবং পানীয় জল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কাজেই কখনও সুড়ঙ্গে অন্ধকার নেমে আসেনি। একটানা ১৮ ঘণ্টা কোনও যোগাযোগ ছিল না। তারপর সুড়ঙ্গের মধ্যে একটি ছোট্ট পাইপের সহযোগিতায় যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। দু কিলোমিটার জায়গায় হাত -পা ছড়িয়ে থাকার সুযোগটুকু ছিল। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য অনেকেই সেখানে হাঁটাচলা করতেন। আবার কেউ ব্যায়াম করতেন। মুক্তির আশাই ছিল সম্বল। দুরূহ সেই উদ্ধারপর্ব করে দেখানোর জন্য প্রশাসন ও উদ্ধারকারীদের কাছ চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন, জানালেন মানিক। সুড়ঙ্গের ২০০৭ সাল থেকে কাজ করছেন। আগে কখনও এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি মানিকের। অবশেষে তিনি বাড়ি ফেরায় খুশি গোটা পরিবার। তবে স্ত্রী সোমা তালুকদারের সাফ কথা, সুড়ঙ্গের কাজে স্বামীকে আর কখনও যেতে দেবেন না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.