ফাইল ছবি
সুব্রত বিশ্বাস ও ধীমান রায়: ট্রেনলাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছেন বাবা। পিছনেই বাবাকে অনুসরণ করে হেঁটে যাচ্ছিল ৬ বছরের ছেলে। তখন পিছনে ট্রেনের হর্ন শোনা যায়। বাবা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর দুহাত বাড়িয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিলেন। একটা শিশুর কাছে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় বাবার কোলে ওঠার পর ছেলে ভেবেছিল ট্রেন আসার কারণে যাতে কোনও বিপদ না ঘটে সেজন্যই তাকে কোলে তুলে নিয়েছে তার বাবা। কিন্তু সেই ভুল ভাঙার আগেই বাবার কোলে চড়েই দুনিয়া ছাড়তে হল নিষ্পাপ শিশুটিকেও। ছয়বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হলেন বাবা।
শুক্রবার সন্ধ্যায় কাটোয়া আজিমগঞ্জ লাইনে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার বাঁদরা রেলগেটের কাছে এক যুবক ও তার সন্তানের ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার করে রেলপুলিশ। রাত পর্যন্ত তাদের পরিচয় জানা যায়নি। তারপর এদিন শনিবার মৃতদের পরিচয় জানতে পারে পুলিশ। পুলিশ জানায় মৃতদের নাম শুভঙ্কর মণ্ডল (৩০) এবং ওঙ্কার মণ্ডল (৬)। বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ থানার রামরাজাপুর এলাকায়। বৈদ্যুতিন সামগ্রীর মেরামতের কাজ করতেন শুভঙ্কর। একমাত্র সন্তানকে কোলে নিয়ে তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন বলে রেলপুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে পারিবারিক অশান্তির জেরেই বাড়ি থেকে ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে কাটোয়ার কাছে আত্মঘাতী হয়েছেন শুভঙ্কর। এদিন শনিবার কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে দেহদুটির ময়নাতদন্ত করানো হয়।
জানা গিয়েছে, লালবাগ থানার রামরাজাপুর এলাকার বাসিন্দা শুভঙ্কররা দুই ভাই। দাদা দীপঙ্করবাবু পুলিশ বিভাগে চাকরি করেন। শুভঙ্কর বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সামগ্রীর মেরামতের কাজ করতেন। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল। বাড়িতে রয়েছেন বিধবা মা শোভারাণীদেবী, স্ত্রী মধূমিতা দেবী। মৃতের পরিজনরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন শুভঙ্কর। তার আগে স্ত্রীর সঙ্গে কোনও কিছু বিষয় নিয়ে শুভঙ্করের অশান্তি হয়েছিল। আর নিজে কোথাও কাজে গেলে বা বাজারহাট করতে গেলে শুভঙ্কর ছেলে ওঙ্কারকে নিয়ে যেতেন। সকাল নাগাদ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার পর আর বাড়ি ফেরেনননি। তারপর অনেক রাতে বাড়িতে তাদের মৃত্যুর খবর ফোন করে জানানো হয়।
রেলপুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় স্থানীয় এলাকা থেকে খবর পেয়ে কাটোয়া স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে বাঁদরা রেলগেট পেড়িয়ে গোয়াই গ্রামের আগে রেললাইনে যে বাঁক রয়েছে সেখান থেকে ওই শিশুসহ দুজনের দেহ উদ্ধার করে রেলপুলিশ। তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করছিল পুলিশ। মৃত শুভঙ্করের পকেট থেকে নোটবুকে লেখা একটি মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। সেই নম্বরে ফোন করে পুলিশ মৃতদের পরিচয় জানতে পারে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন ঘটনার অনেক আগেই ছেলেকে নিয়ে কাটোয়া স্টেশনে নেমেছিলেন শুভঙ্কর। তারপর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে একটি হোটেলে খেতে গিয়েছিলেন। বাবা ছেলে একসাথে খাওয়াদাওয়া সারেন।
ছেলেকে স্টেশনে চকলেট,চিপস ইত্যাদি কিনেও দিয়েছিলেন। তারপর বিকেল তিনটে নাগাদ রেললাইন ধরে ছেলেকে নিয়ে আজিমগঞ্জ মুখে তাকে হেঁটে যেতে দেখেন কয়েকজন। বাবার পিছনেই গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল ছোট্ট ওঙ্কার। বেশকিছুটা যাওয়ার পর বিকেল ৩-৫০ মিনিট নাগাদ কাটোয়া আজিমগঞ্জ আপ লোকাল কাটোয়া স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর ওই ট্রেনের সামনেই ছেলেকে কোলে নিয়ে ঝাঁপ দিতে দেখা যায়। স্থানীয় এলাকার কয়েকজন দেখতে পান ট্রেনের হর্ন শুনে পিছনে একবার তাকিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন শুভঙ্করবাবু। খবর পেয়ে এদিন প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা হাসপাতালে দেহ ময়নাতদন্তের সময় আসেন। স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তির কারণ নিয়ে তারা অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি। মৃত শুভঙ্করের মামা দিব্যেন্দু দাস বলেন,”আমার যদিও পাশের গ্রামে বাড়ি। কিন্তু কর্মসূত্রে বাইরে থাকি। জানিনা কেন ও ছেলেকে নিয়ে আত্মঘাতী হল।” খবর পেয়ে শুভঙ্করের বিধবা মা ও স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.