কিংশুক প্রামাণিক: বাংলার রাজনীতির মহাকাশে নতুন অধ্যায় রচনা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ একক দল হিসাবে শুধু ক্ষমতায় ফেরাই নয়, দুই-তৃতীয়াংশের বেশি গরিষ্ঠতা পেল তৃণমূল কংগ্রেস৷ তৈরি হল নতুন ইতিহাস৷
পাঁচ বছর আগে পরিবর্তনের ভোটে প্রবল পরাক্রমী সিপিএম পার্টির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন এই মমতাই৷ এবার আক্ষরিক অর্থেই সূর্যকান্ত মিশ্রদের ‘ছাগলের তৃতীয় ছানায়’ (সৌজন্য মানিক সরকার) পরিণত করলেন তিনি৷ তৃণমূলনেত্রী যখন ২১১ আসন নিয়ে বিধানচন্দ্র রায়কে ছাপিয়ে গেলেন, তখন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বিধায়ক সংখ্যা মাত্র ২৬৷ বামফ্রন্ট (যে কথাটি এই ভোটে অনুচ্চারিত) ৩২৷ গোটা বাংলায় ধুয়েমুছে সাফ লাল পার্টি৷
রাজ্যজুড়ে শুধুই সবুজ বিপ্লব৷ খানিকটা মুখরক্ষা কংগ্রেসের৷ সিপিএমকে নিজেদের ভোট হস্তান্তর না করে ডুবিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস৷ পক্ষান্তরে অবশ্য সিপিএমের ভোট পেয়েই তারা পেয়েছে ৪৪ আসন৷ গতবারের চেয়ে দু’টি বেশি৷ অর্থাৎ এই ফলাফলের জেরে বিধানসভায় সিপিএমের বিরোধী দলের মর্যাদাও আর থাকল না৷ চলে গেল কংগ্রেসের হাতে৷ বিজেপি এই প্রথম বিধানসভা ভোটে খাতা খুলল বাংলায়৷ তারা পেয়েছে তিনটি আসন৷ সব মিলিয়ে এদিন দেখা গেল জোটকে কেন্দ্র করে এতদিন যা যা হয়েছে তা পুরোটাই ফাঁপা৷ বিশ্বাসযোগ্যতা, সংগঠন ও ভোটব্যাঙ্ক কিছুই নেই৷ ফলে বৃহস্পতিবার সকালে ভোটবাক্স খুলতেই শুরু মমতা-ম্যাজিক৷ আবার স্পষ্ট হল, জনপ্রিয়তার নিরিখে মানুষের কোন মণিকোঠায় রয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী৷ লোকসভা ভোটের চেয়েও প্রায় ৬ শতাংশ ভোট বাড়ল তৃণমূলের৷ অর্থাত্ ৪৫ শতাংশ ভোট এককভাবে পেয়ে নজির গড়লেন মমতা৷
ঐতিহাসিক এই জয়কে সেলিব্রেট করতে অভিনব আয়োজন৷ শুক্রবার দিনটি নেত্রীর বরাবরই পয়মন্ত৷ আগামী ২৭ মে শুক্রবার রাজভবন নয়, রেড রোডে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন মমতা৷ তার আগে আজ, শুক্রবার কালীঘাটে দলীয় অফিসে ২১১ জন তৃণমূল বিধায়ক তাঁদের দলনেত্রীকে মনোনীত করবেন৷ এর পর নেত্রী তৈরি করবেন তাঁর মন্ত্রিসভা৷ মণীশ গুপ্ত, উপেন বিশ্বাসের মতো কয়েকজন মন্ত্রী যেমন হেরেছেন, তেমনই নতুন অনেকে জিতেছেন৷ জেলাভিত্তিক ভারসাম্য রেখেই তালিকা তৈরি হবে৷
জয়ের পর উল্লাস তৃণমূল সমর্থকদের৷ বৃহস্পতিবার৷ ছবি: শুভাশিস রায়।
এক কথায় মমতার এই জয় সবদিক থেকেই অনন্য৷ জনরায়কে হাতিয়ার করেই অনেকের মুখ একসঙ্গে তিনি বন্ধ করে দিলেন৷ নির্বাচনী প্রচারে বিরোধীরা ব্যক্তি আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে৷ জীবনে যিনি কারও পয়সায় এককাপ চা-ও খেলেন না, তাঁকে চোর বলতেও পিছপা হয়নি বিরোধীরা৷ তৃণমূল নেত্রীর সেই অপমানের জ্বালা মানুষ জুড়িয়ে গেল ভোটবাক্সেই৷ গতবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তৃণমূল পেয়েছিল ১৮৪টি আসন৷ আর এবার ২৯৪ আসনে একা প্রার্থী দিয়ে ২১১টিতে জয়৷ ঐতিহাসিক এই জয় জনগণকে উৎসর্গ করে আজ, শুক্রবার থেকে আগামী ১০ দিন বিজয় উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল৷ আর কেন্দ্রীয়ভাবে এই জয় পালন করা হবে মা-মাটি-মানুষ দিবস ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে৷
তবে দেশের অন্যত্র যখন প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া, তখন মমতা তাঁর সবুজ গড় অটুট রাখায় জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্ব আরও খানিকটা বেড়ে গিয়েছে৷ ফের সামনে এসেছে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে ফের তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের বিষয়টি৷ যদিও নেত্রী এ নিয়ে এদিন কিছু বলতে চাননি৷ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিং, চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতীশ কুমার, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ঘনিষ্ঠ আহমেদ প্যাটেল, অমিতাভ বচ্চন-সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ এদিন তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন৷
শপথেও আসতে চান অনেকে৷ লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে তিনি যে এবার সংগঠনকে অন্য রাজ্যে বিস্তারের কাজ শুরু করবেন সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন মমতা৷ এদিন কালীঘাটে এসেও বহু বিশিষ্ট মানুষ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে যান৷ আসেন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজিপি, সিপি প্রমুখ৷
গতবার ‘বদলা নয়, বদল চাই’ স্লোগান দিয়ে জয়ের পর রবীন্দ্রসংগীত বাজাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন নেত্রী৷ এবার অবশ্য পরিবেশ ছিল আরও তপ্ত৷ নেত্রীকে ব্যক্তি আক্রমণ এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, মনে করা হচ্ছিল ভোটে শাসক দল জিতলে প্রবল সংঘর্ষ শুরু হবে৷ কিন্তু এদিন কর্মীদের শান্ত, সংযত ও দায়িত্ববান থাকার পরামর্শ দিয়ে রাজধর্ম পালন করেন মমতা৷ এমনকী বিরোধীদেরও প্রতি-আক্রমণ না করে সৌজন্য দেখিয়েছেন৷ পাশাপাশি যাঁদের আক্রমণে তিনি ক্ষত-বিক্ষত তাঁদের উদ্দেশে বলেছেন, “আপনারা ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন৷ আর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিন৷ মানুষই সব৷ আমি তাঁদের উপরই আস্থা রেখেছিলাম৷”
শুধু দুঃখ একটাই৷ ঘরে মা গায়ত্রীদেবী নেই৷ গত রাতে তিনি এসেছিলেন স্বপ্নে৷ আশ্বস্ত করেছিলেন৷ একথা যখন বলছেন, চিকচিক করছে তাঁর চোখ৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.