কিংশুক প্রামাণিক: দ্বিতীয় ইনিংস যে অন্যরকম হবে, তা ভোটে জেতার পরই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন৷ দলকে কঠোর শৃঙ্খলার মোড়কে বাঁধার পর এবার প্রশাসনিক সংস্কারেও মন দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বিভিন্ন দফতরে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ঘুঘুর বাসা ভাঙতে নামলেন তিনি৷ বুধবার শিলিগুড়ির উত্তরকন্যায় তিন জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে নরমে-গরমে তা বুঝিয়েও দিলেন৷
মূলত, পূর্ত, সেচ, বন ও পরিবহণ, এই চার দফতরকে এদিন নিশানা করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ মঞ্চে প্রশাসনিক কর্তা ও তিন জেলার ওসি থেকে বিডিও, এসডিও৷ তাঁদের সামনেই যেন মৌচাকে ঢিল মুখ্যমন্ত্রীর৷ কোন ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে তিনি বলেন, “পূর্ত ও সেচ দফতরে লুঠ চলছে৷ নিম্নমানের মাল সরবরাহ করা হচ্ছে৷ প্রতি বছরই দেখছি ভাঙন আটকাতে বাঁধ তৈরি হচ্ছে৷ কেন হয়? ভাঙনের টাকা জলে যাচ্ছে৷ কোনও প্ল্যানিং নেই৷ আবার নদী থেকে পাথর তুলে সেই পাথর রাজ্যকেই বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে৷ এমনকী, ভিন দেশেও পাচার হচ্ছে৷ পুলিশের নাকের ডগায় এসব হচ্ছে৷”
এদিন মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “সেই নিম্নমানের পাথর দিয়েই রাস্তা হচ্ছে৷ রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে৷ সরকারের টাকা কি খোলামকুচি? কত কষ্ট করে আমাকে চালাতে হয়৷ ৫৩ হাজার কোটি টাকা রাজ্যের রোজগার, অথচ ৬০ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে বামেদের করে যাওয়া ঋণ শোধ করতে৷ ফলে সরকারের একটি পয়সাও নষ্ট করা যাবে না৷”
এর পরই মমতা মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন, “সেচ ও পূর্ত দফতরকে নিয়ে বসুন৷ আলোচনা করুন৷” সেচ সচিবকে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সরকারের এত টাকা নেই যে বছর বছর দিতে পারবে৷ দুর্নীতিগ্রস্তদের রেহাই নেই৷ কোনও ব্ল্যাকমেলিং চলবে না৷” পাশে বসা পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে তিনি বলেন, “এক্সপার্ট কমিটি গঠন করুন৷ বাঁধ তৈরিতে ২০ বছরের প্ল্যান তৈরি করতে হবে৷” ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী অতঃপর নির্দেশ দেন, “এই মুহূর্ত থেকে সরকার ঘোষণা করছে, অনুমতি ছাড়া নদী থেকে কেউ পাথর তুলতে পারবে না৷ প্রশাসন যেন নজর রাখে৷ যে তুলবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷”
বস্তুত, সেচ ও পূর্ত– এই দুই দফতরে বাম জমানা থেকেই ঘুঘুর বাসা সক্রিয়৷ রাজ্য রাজনীতিতে পরিবর্তন হলেও এক শ্রেণির মৌরসিপাট্টা বন্ধ করা যায়নি৷ যার ফলেই ব্যর্থতা সামনে আসছে৷ তাই এদিন কঠোর হাতেই দুই দফতরের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এর পর তিনি বন দফতর ও পরিবহণ দফতরকে একহাত নেন৷ কীভাবে বনের কাঠ চুরি হয়, শিলিগুড়ির মতো জায়গায় সরকারি বাস স্ট্যান্ড বেসরকারি দখলদারীদের হাতে চলে যায়, তা নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মমতা৷ এগুলি যে আর চলবে না, তা জানিয়ে কৈফিয়ত তলব করেন৷
এদিন আবার জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সরব হন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর সরকার যেমন জোর করে জমি নেয় না, তেমন জবরদখলও যে আর বরদাস্ত করবে না, তা বলে দেন তিনি৷ রাজ্যের বড়সড় সমস্যা বাংলাদেশ সীমান্ত৷ সীমান্ত প্রহরা রাজ্যের হাতে নেই৷ ফলে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না৷ কিন্তু এগুলি যে আদতে রাজ্যের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী এতটা সরব হলেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷ প্রশাসনকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, সীমান্তে ওয়াচ টাওয়ার বানিয়ে নজরদারি চালাতে হবে৷ বস্তুত, উত্তরবঙ্গ সফরের তৃতীয়দিন উত্তরকন্যাতেই ছিল এদিনের প্রশাসনিক বৈঠক৷ দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার তিন জেলার কাজ নিয়েই পর্যালোচনা৷
এদিন মমতা প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের মঞ্চে বসিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি এবার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবেন৷ কারণ, মানুষ তাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা সুষ্ঠুভাবে পালন করতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ জনপ্রতিনিধিদের সেকথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, মানুষের উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনও স্বার্থ কারও নেই৷ প্রশাসনের সঙ্গে ঐক্যবভাবে কাজ করতে হবে৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.