সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: দীর্ঘ ১০ বছরের লড়াই-আন্দোলনের শেষে বুধবার সিঙ্গুরের স্বপ্নপূরণের দিন! এদিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৮০৬ জন কৃষকের হাতে তুলে দিলেন ক্ষতিপূরণের চেক৷ বললেন, “এটা মানুষের জয়। আমরা যা কথা দিয়েছিলাম তা আমরা রেখেছি৷ পুজোর আগে পুজোর আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম৷”
চেকের পাশাপাশি ৯১১৭ জনের হাতে জমির পরচাও তুলে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ প্রয়োজনে বুধবার রাত পর্যন্ত পরচা বিলির কাজ চলবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পরচা বিলি শুরু হয়, পরে অনিচ্ছুক কৃষকদের হাতে চেক-পরচা তুলে দেন রাজ্যের দশ মন্ত্রী৷ এদিন সিঙ্গুরে মমতার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মেধা পাটেকর৷ তাঁর বক্তব্য, “আজ সিঙ্গুরের পুনর্জন্ম হল৷ ঐতিহাসিক আন্দোলনে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছেন মমতাদি৷”
এদিন সিঙ্গুর থেকেই ফের টাটাদের উদ্দেশে বিনিয়োগের বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী৷ বলেন, “১০০০ একর নিয়ে জেদাজেদি করতে গিয়ে সিঙ্গুরে টাটারা কারখানাই করতে পারলেন না৷ এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি৷ নতুন করে ভাবুন৷” মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা, বাংলাকে বঞ্চিত হতে দেব না৷ টাটাই হোক বা বিএমডব্লিউ হোক, সবাইকে স্বাগত৷ গোয়ালতোড়ে রাজ্য সরকারের ল্যান্ড ব্যাঙ্কে ১০০০ একর জমি রয়েছে৷ যাঁরা অটোমোবাইল কারখানা তৈরি করতে চান তাঁরা সরকারের কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷
এদিন মঞ্চ থেকে সিঙ্গুর আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সেদিন নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলাম৷ ২০০৬ সালে দুর্গাপুজোর আগে শুরু হয়েছিল সিঙ্গুর আন্দোলন। সেদিনের মাঝরাতে বিডিও অফিসের অত্যাচারের কথা আমি এখনও ভুলিনি৷ ২ সেপ্টেম্বর মহিলাদের ওপর মর্মান্তিক অত্যাচার করা হয়েছিল৷”
সিঙ্গুরে ৯৭৭ একর জমির মধ্যে ৬২৩ একর জমি সমীক্ষার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে বলে এদিনের সভা থেকে জানিয়েছেন মমতা৷ কৃষকরা যাতে ঋণ পায় তার জন্য একটি কাস্টমস নিয়োগ কেন্দ্র সিঙ্গুরে স্থাপন করা হবে বলেও জানিয়েছেন নেত্রী৷ সঙ্গে ২ টাকা কেজি দরে চাল ও চাষ করার জন্য কৃষকদের ১০ হাজার টাকা করে দেবে রাজ্য সরকার, ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর৷
বুধবারের সকালটা সিঙ্গুরবাসীর কাছে একটু অন্যরকম৷ চারদিকে প্রাণ খোলা ছবি৷ স্বস্তির নিঃশ্বাস৷ এলাকাজুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে নিবিড় আনন্দ৷ আজ সিঙ্গুরবাসীর চোখের কোণে জল নেই৷ মুখে শুধুই হাসি৷ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর আবেগ৷ আনন্দ বয়ে যাচ্ছে বাজেমেলিয়া, জয়মোল্লা, শানাপাড়া, বেড়াবেড়ি, গোপালনগর, খাসেরভেড়ি গ্রাম৷ সিঙ্গুর-জুড়ে শুধুই উৎসবের মেজাজ৷ লড়াই আন্দোলনের শেষে জয়৷ সম্পূর্ণ হল বৃত্তটা৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুর্নিশ জানাল সিঙ্গুরের আপামর জনগণ৷ স্বভাবতই সিঙ্গুরের প্রতি ঘরে আজ শুধুই উৎসবের মেজাজ৷ প্রতি ঘরে চড়েছে বড় বড় হাঁড়ি৷ বাড়ির মা-বউমারা সকাল থেকেই ব্যস্ত রান্নাবান্নায়৷ বেড়াবেড়ি, জয়মোল্লার বাসিন্দারা বলছিলেন, আজ আমাদের খুশির দিন৷ আনন্দ ভাগ করে নিতে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন আত্মীয়স্বজন৷ সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব৷ সিঙ্গুরের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়রা যে যেখানেই ছিলেন, তাঁরা চলে এসেছেন৷ একসঙ্গে বিজয় উৎসবের অনুষ্ঠানে যাব৷ তার পর একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব, আনন্দ করব৷
দুর্গাপুজোর আগে এতবড় উৎসব আগে কখনও দেখেনি সিঙ্গুর৷ অপেক্ষা ছিল এই দিনটারই৷ তাই আর তর সইছিল না সিঙ্গুরবাসীর৷ বলা ভাল রাজ্যবাসীর৷ মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, মেদিনীপুর-সহ রাজ্যের প্রায় সব জেলার মানুষ কাকভোরেই হাজির হয়ে যান সিঙ্গুরে৷ কারও মাথায় তৃণমূলের পতাকা৷ কারও গলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি৷ কারও বা জামার উপর লাগানো ব্যাজ, যাতে লেখা, “মমতা তুমিই পার৷ ফিরিয়ে দিলে কৃষকের অধিকার৷” কেউ আবার জামার উপর গাউন পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সিঙ্গুরের মঞ্চের চারধারে৷ গাউনে লেখা, “আমরা মায়ের জয়গান গাই৷ মাটির জয়গান গাই৷” তাপসী মালিকের বাবা মনোরঞ্জন মালিক বলেন, “আজ আনন্দের দিন৷ কিন্তু চোখে জল চলে আসছে৷ মেয়েটা যদি বেঁচে থাকত৷ আর এই দিনটা দেখতে পেত, তাহলেই সব এক জায়গায় মিশে যেত৷” অনুষ্ঠানের শেষে তাপসী মালিকের মায়ের হাতে একটি লক্ষ্মী প্রতিমা তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী৷ বিকেলের পড়ন্ত রোদের আলোয় তার চোখের কোণও তখন চকচক করছে৷ বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়৷ অনুষ্ঠানের একেবারে শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “চোখের জল আজ আনন্দধারা হয়ে ঝরছে৷”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.