কিংশুক প্রামাণিক, কুসুম্বা: এই বাড়িতে তাঁর জন্ম হয়েছিল। টিনের চাল, মাটির দোতলা ঘরগুলো অবিকল আছে। ওপরের ঘরের আড়া থেকে ঝুলছে জমির রাশি রাশি পিঁয়াজ। যেমন সেদিনও ঝুলত। শুধু মামার মুদিখানার দোকানটি নেই। মামা অনিল মুখোপাধ্যয় এখনও বেশ শক্তপোক্ত। তিনি একটু এদিক-ওদিক গেলেই বাড়ির দিদি বোনেদের নিয়ে দস্যি মেয়েটা চুপিসারে দোকানে ঢুকত। বয়ামে রাখা চানাচুর, লজেন্স, আচার খেয়ে নিয়ে দে ছুট। মামা তো রেগে অগ্নিশর্মা। কিন্তু আজ সেই মেয়েটার মুখ থেকে পুরনো কথা শুনে সে কী হাসি বৃদ্ধের। হাসবেন না কেন? বাড়ির সামনের ভট্টাচার্য পুকুরে সাঁতার কাটা, খেত জমিতে ধান রুইতে শেখা ভাগনিটি যে আজ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বুধবার সেই ঘরে বসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে পড়ে গেল ছোটবেলার এক রাতের কথা।
[ প্রধানমন্ত্রীর সভার জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বিতর্ক তুঙ্গে ঠাকুরনগরে]
তখন প্রথম কি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন। মা গায়ত্রী দেবীর হাত ধরে এসেছেন মামার বাড়ি কুসুম্বায়। হঠাৎ গ্রামে হইচই। খবর এল ডাকাত পড়েছে। ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে গেল মাটির বাড়ির দরজা জানালা। মেয়েরা হাতে কানে গলায় যেটুকু সোনা ছিল লুকিয়ে ফেলতে লাগল। গ্রামে তখন ভয়ে কুঁকড়ে সবাই। কী হয়, কী হয়। দস্যি মেয়েটার কী তখন মনে হয়েছিল, ডাকাত তো কী, চলো সবাই মিলে প্রতিরোধ করি। মনে হলেও কিছু করার ছিল না। কারণ সে তো নেহাত শিশু। এইটুকু বলে থামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। না থেমে উপায় কী? মাটির ঘরে উপচে পড়ছে ভিড়। সবাই তাঁকে ছুঁয়ে দেখবে। বাইরে কুসুম্বা হাইস্কুল ও জাগ্রত খ্যাপা মা মন্দিরের সামনে ভেঙে পড়েছে গোটা গ্রাম। হবে নাই বা কেন? এই গ্রামে জন্ম নেওয়া মেয়েটিই আজ দেশনেত্রী। রেলমন্ত্রী হয়ে এসেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হয়েও এসেছেন। কিন্তু তাঁর আসা মানেই কুসুম্বায় এক দৃশ্য।
এবার এক অন্য ঘটনা। বলা যেতে পারে আবিষ্কার। যে কথা এত দিন অজানাই ছিল। আচমকা যার সাক্ষী হলাম। ঘরের মধ্যে ভিড় ঠেলে মুখ্যমন্ত্রীর দিকে এগিয়ে এলেন এক গ্রামীণ বধূ। নাম সোমা। তিনি এসেছেন সিউড়ি থেকে। কিন্তু তাঁর বাপের বাড়ি এই কুসুম্বার কিছুটা দূরে চকাইপুর গ্রামে। ওখানে বন্দ্যোপাধ্যায় ভবনের মেয়ে তিনি। নিজেই সেকথা বললেন মমতাকে। শুনেই চমকে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, “সে কী, তুমি এসেছ আমার আদি বাড়ি থেকে? কত খুঁজেছি তোমাদের। ওটাই ছিল আমাদের পরিবারের ভিটে। বাবা সব দান করে কলকাতা চলে আসেন। তারপর আমাদের সঙ্গে বংশভিটের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।” খেয়াল করছিলাম তখন নস্টালজিক এক নারীকে। আবেগরুদ্ধ। কে বলবে একটু আগেই রামপুরহাটের সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে কামান দেগেছেন। ঠিক তখন স্থানীয় নেতা কৃষিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন একটি কাগজ। আসলে ওটি একটি পর্চা। চকমণ্ডলায় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দেবোত্তর জমি। চার একর। যাতে নাম লেখা মুখ্যমন্ত্রীর ঠাকুরদা, জেঠামশাই ও বাবার। মন্ত্রী জানালেন, জমির একাংশের ভাগ মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের। শোনামাত্র মমতা বললেন, ‘শুনেছি ওখানে মন্দির করতে চাইছে। ঠিক আছে। জমি দান করে দিলাম। হোক মন্দির।” পাশে তখন ভাইপো অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়ের মা লতাদেবীও। মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন।
এবার যেতে হবে এই বাড়ি থেকে একটু দূরে মন্টা দাসের বাড়ি। সেখানে যাবেন বলে এই দফায় জন্মভূমিতে এসেছেন। বাড়ি থেকে বেরোতেই ঘিরে ধরল গ্রামের মানুষ। অনেকেই তাঁর পরিচিত। অনেকে এসেছেন সেই চকাইপুর থেকে। ওঁদের দাবি, দিদি একবার চলো তোমার নিজের গ্রামে। নাছোড় সেই আর্তি। এই ডাকেরই যেন অপেক্ষায় ছিলেন মমতা। তৃপ্ত হয়ে নিজ গ্রামের মানুষদের কথা দিলেন, অবশ্যই আসবেন। তবে পরের বার। এই হলেন কুসুম্বার মেয়ে মমতা। সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায় পৌছেও যিনি মাটিকে ভুলে যাননি।
[ বিদায়বেলায় শীতের ছক্কা, এক ধাক্কায় পারদ নামল ৫ ডিগ্রি]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.