সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ভোটপ্রচারে তিনি দাবি করেছিলেন, বাংলার ২৯৪টি আসনে তিনিই প্রার্থী। ভোটের ফলাফল জানাল তা স্রেফ মুখের কথা নয়, বাংলার রায় আদতে এই মুখেই সায়। ইতিহাস গড়ে তাই দ্বিতীয়বার বাংলার মসনদে বসতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সারদা-নারদা-উড়ালপুল বিপর্যয় নাকি কন্যাশ্রী-যুবশ্রী-সবুজসাথী-দু’টাকা কিলো দরে চাল? এবারের ভোটের ভরকেন্দ্র যেন হয়ে উঠেছিল এ প্রশ্নই। ২০১১ সালে কংগ্রেসকে সঙ্গী করে বাংলায় ‘পরিবর্তন’ এনেছিলেন মমতা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পর রাজ্যের বামশাসকের প্রতি বীতশ্রদ্ধ জনতা সায় দিয়েছিল মমতাতেই। তারপর এই পাঁচ বছরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিরোধী নেত্রী হিসেবে যে ‘অগ্নিকন্যা’র ইমেজ একদা ছিল তৃণমূল সুপ্রিমোর, শাসক হিসেবে তা যেন অনেকের কাছেই ফিকে হতে শুরু করেছিল। তাঁর নানা কাজে ক্রমশ উঠছিল সমালোচনার ঢেউ। যত দিন গড়িয়েছে তা আরও প্রখর হয়েছে। শহর নীল-সাদা রঙ থেকে ত্রিফলা বাতির আলোকসজ্জা কিংবা প্রশাসনিক কার্যালয় নবান্ন ভবনে স্থানান্তর- নানা বিষয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। এরই মধ্যে ঘটেছে সারদাকাণ্ড। শাসকদলের একাধিকজনের নাম জড়িয়েছে তাতে। এমনকি তাঁর মন্ত্রিসভার এক সদস্যও জেলবন্দি। একটার পর একটা বছর পেরিয়েছে, আর অভিযোগের অক্টোপাস তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। যে সিঙ্গুর আন্দোলন তাঁকে ঘুরে দাঁড়ানোর জমি দিয়েছিল, তাঁর জমিনীতি সেখানকার অনিচ্ছুক কৃষকদের এখনও জমি ফিরিয়ে দিতে পারেনি। সুযোগ বুঝে মাথাচাড়া দিয়েছে রাজনৈতিক বিরোধিতাও। এমনকী তাঁর একদা পরিবর্তনের সঙ্গীরাও তাঁকে ছেড়ে গিয়েছেন। তাঁর সরকারের আয়োজিত পুরস্কার অনুষ্ঠান কিংবা চলচ্চিত্র উৎসবও বিরোধিতায় হয়ে উঠেছে ‘কার্নিভাল’। আর এ সবের মধ্যেই চাপা পড়ে গিয়েছে তাঁর ‘কন্যাশ্রী’ থেকে ‘যুবশ্রী’, ‘সবুজসাথী’ থেকে ‘জঙ্গলকন্যা’। জল-রাস্তা-বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান ঢাকা পড়ে গিয়েছে রাস্তার নাম পরিবর্তনের সমালোচনায়।
পাঁচ বছর পেরিয়ে আবার একটি বিধানসভা ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে তাই মেঘে ঢাকা হয়ে ছিল তাঁর উন্নয়নের খতিয়ান। তিনি নিজেও প্রচারে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, উন্নয়ন নয় কুৎসাই এবার ভোটের মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে ভোটের মুখে এসেছিল নারদাকাণ্ড। ভোটের হাওয়া আগেভাগে আঁচ করে অনেকেই বলেছিলেন, একাংশের মানুষের সমর্থন হারিয়েছেন মমতা। শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণিও তাঁর নানা কাজে বীতশ্রদ্ধ এমন অনুমানও করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু ভোটের ফল জানাল, সমস্ত সমালোচনার চড়াই পেরিয়ে মানুষ আসলে বেছে নিয়েছেন উন্নয়নকেই।
প্রায় নজিরবিহীনভাবে এ রাজ্যে ভোট হয়েছে এবার। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা, রাজ্য পুলিশের নিরপেক্ষ কাজে শাসকদলের বিরুদ্ধে কার্যত তেমন কোনও কারচুপির অভিযোগই তুলতে পারেনি বিরোধীরা। উল্টে দফায় দফায় ভোটশেষে বিরোধীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন কমিশনের ভূমিকায়। অর্থাৎ তথাকথিত ‘ভূত’ নয়, ইভিএমে যে জনতার রায়ই প্রতিফলিত হয়েছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। আরও এক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এবারের ভোট। শুধু শাসকদলকে আটকাতেই রাজ্যের চিরশত্রুতার ইতিহাস ভুলে জোট বেঁধেছিল বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেস। রাজ্য-রাজনীতিতে যা ছিল একেবারে ভিন্ন মাত্রার। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েই সংগঠিত বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে একা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মমতা। ফলত চাপ ছিল মমতার উপর। এখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃণমূল যখন দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের পথে, তখন ভোটের ফল প্রমাণ দিচ্ছে সে সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল। রাজ্যে তো বটেই, জাতীয় রাজনীতিতেও এ ফলাফল যে মমতার পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর নিজের কেন্দ্র ভবানীপুরেও তাঁর ‘ঘরের মেয়ে’র পাল্টা ইমেজ হিসেবে প্রজেক্ট করা হয়েছিল জোটপ্রার্থী দীপা দাশমুন্সির ‘ঘরের বউ’ ইমেজটিকে। কিন্তু বেলাশেষে দেখা গেল সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। সারদা-নারদার পরিবর্তে মানুষের আস্থা যে দু’কেজি কিলোদরের চালেই বেশি, তা বাংলার জনতা এদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন ২১১টি আসনে।
ভোটের হাওয়া আগেভাগে আঁচ করে অনেকেই বলেছিলেন, একাংশের মানুষের সমর্থন হারিয়েছেন মমতা। শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণিও তাঁর নানা কাজে বীতশ্রদ্ধ এমন অনুমানও করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু ভোটের ফল জানাল, সমস্ত সমালোচনার চড়াই পেরিয়ে মানুষ আসলে বেছে নিয়েছেন উন্নয়নকেই।
এদিন একের পর এক আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের খবর আসতেই কালীঘাটের বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করেন মমতা। আর সেখানে বিরোধীদের জোট করার এই সিদ্ধান্তকে ‘ব্লান্ডার’ বলতে দ্বিধা করেননি। নির্ভীকভাবে ভোটদানের জন্য মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে এদিন মমতা বলেন, “অনেক কুৎসা, চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু মানুষ তা প্রত্যাখান করেছে। সমস্ত দুর্নীতির অভিযোগ মানুষই খারিজ করেছে।” ২৭ মে নব নির্বাচিত সরকারের শপথগ্রহণ। রাজভবনে নয়, রেডরোডে এবার অনুষ্ঠান করে শপথ গ্রহণ করবেন তিনি।
শুধু তৃণমূল কংগ্রেসের জন্যই নয়, বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসেও এই জয় নানাকারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকল। যেমন এই ভোট থেকেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে কামব্যাক কংগ্রেসের। জোট থেকে গুড় যে কংগ্রেসই খেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলত রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে উঠল বামশক্তি। ৩৪ বছর ক্ষমতার অলিন্দে থাকার পর পাঁচ বছরে বিরোধী শক্তি হিসেবে তাদের পকেটে মোটে ৩২টি আসন। নিঃসন্দেহে সামগ্রিক বামদলগুলির কাছে তা হতাশাজনক। রাজ্যে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধিও এবারের ভোটের ফলাফলে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শিল্পায়ন নিয়ে বাংলার প্রত্যাশা এবার রাখতে পারবেন তো মমতা? উন্নয়নের গতিমুখে যে বদল বাংলার একশ্রেণির মানুষ প্রত্যাশা করে এসেছেন এবং তিনিই তা পূরণ করতে পারবেন বলে তাঁর উপর যে আস্থা রাখল মানুষ, নিঃসন্দেহে তা বাড়তি চাপে রাখবে নয়া সরকারকে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা শিল্পের নিরিখে পড়শি রাজ্যগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে যে উন্নয়ননীতি প্রয়োজন, মমতার কাছে এবার বাংলার জনগণের প্রত্যাশা থাকবে তাইই।
এই যখন বিরোধী শিবিরের অন্তঃসারশূন্য চিত্র, তখন শাসকদলের শিবির কিন্তু অনেকটাই সমৃদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি মমতা সরকারকে বাড়তি মোমেন্টাম দেবে? একরকম উন্নয়নের ছবি তিনি এতদিনে তুলে ধরতে পেরেছেন, কিন্তু শিল্পায়ন নিয়ে বাংলার প্রত্যাশা এবার রাখতে পারবেন তো মমতা? উন্নয়নের গতিমুখে যে বদল বাংলার একশ্রেণির মানুষ প্রত্যাশা করে এসেছেন এবং তিনিই তা পূরণ করতে পারবেন বলে তাঁর উপর যে আস্থা রাখল মানুষ, নিঃসন্দেহে তা বাড়তি চাপে রাখবে নয়া সরকারকে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা শিল্পের নিরিখে পড়শি রাজ্যগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে যে উন্নয়ননীতি প্রয়োজন, মমতার কাছে এবার বাংলার জনগণের প্রত্যাশা থাকবে তাইই। পাশাপাশি দলীয় নেতৃত্বের ক্রমাগত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া নিয়ে দলের অন্দরেই যে অসন্তোষ ও অন্তর্ঘাত তা কি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন মমতা? বিজয়মিছিলের উচ্ছ্বাসের ভিতরই ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছে এ প্রশ্নও।
মানুষ তাঁর উপর আস্থা রেখেছে। রাজনৈতিক কেরিয়ারে শাসক হিসেবে যেন প্রথম ইনিংসেই সেঞ্চুরি হাঁকালেন তিনি। কিন্তু কিছু লোপ্পা ক্যাচ, কিছু ভুল শট, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে কিছু ভুল বোঝাবুঝি যেন থেকেই গিয়েছে। বাংলার প্রত্যাশা, ভুল-চুক শুধরে দ্বিতীয় ইনিংসে রাজনীতিক হিসেবে আরও সার্থক হয়ে উঠবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং তাঁর সরকারও আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠবে জনগণের সরকার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.