সুরজিৎ দেব, কাকদ্বীপ: বুলবুল ঘূর্ণীঝড়ের দাপটে কাকদ্বীর-সহ সুন্দরবনের আরও বেশ কিছু এলাকা। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন অনেকেই। ঝড়ের কোপে ট্রলার উলটে মৃত্যু হয়েছে অনেক মৎসজীবীর। কিন্তু ওই ঝড়েও কেন সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন মৎসজীবীরা, সেই প্রশ্নই উঠে এসেছে একাধিকবার। ক্ষুব্ধ মৎসজীবীদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, অধিক লাভের আশায় ট্রলার মালিকরা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন সুন্দরবনের মৎসজীবীদের। অন্যদিকে, সোমবার বুলবুল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে মৃত মৎসজীবী সঞ্জয় দাসের পরিবারের হাতে ২ লক্ষ টাকার চেক তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে সেই কোন সাতসকালে কাকদ্বীপের স্টেডিয়াম মাঠে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক মহিলা। কোলে ছিল সাত মাসের ছেলে সার্থক আর পাশেই ছিল দশ বছরের মেয়ে মামণি। তিনি ববিতা দাস। তাঁর স্বামী সঞ্জয়ের দেহ উদ্ধার হয়েছে ২৪ ঘণ্টা আগেই। কাকদ্বীপে প্রশাসনিক বৈঠক শেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাছে টেনে নিলেন তাঁকে। ছোট্ট সার্থককে পরম আদরে নিজের কোলে তুলে নেন মুখ্যমন্ত্রী। সান্তনা দেন সদ্য স্বামীহারা মহিলাকে। মুখ্যমন্ত্রীর সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ববিতাদেবী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হাতে অর্থসাহায্য হিসাবে দু’লক্ষ টাকার একটি চেক তুলে দেন। ওই মহিলার কোনওরকম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী আলোচনা করেন জেলাশাসকের সঙ্গে।
কাকদ্বীপ স্টিমার ঘাটের বাসিন্দাদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী পরিবার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে বেরোন। সঞ্জয়ের শোকার্ত পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এসেছিলেন কাকদ্বীপ স্টিমার ঘাটের বহু মৎস্যজীবী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনেরা। শনিবার রাতে ফ্রেজারগঞ্জের পাতিবুনিয়ার খালে নোঙর করেছিল বেশ কিছু ট্রলার। প্রশাসনের সতর্কবার্তা পেয়ে সেখানেই এসে নোঙর করে ট্রলার এফবি চন্দ্রানীও। ট্রলারটিতে ছিলেন মোট ১২ জন মৎসজীবী। বুলবুলের তাণ্ডব শুরু হতেই তিন মৎস্যজীবী ট্রলার থেকে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে পাড়ে উঠে নিজেদের জীবন বাঁচান। কিন্তু ট্রলার তখন উলটে যাওয়ায় এবং ঝড়ের প্রকোপ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের আর বাঁচাতে পারেননি বাকি ন’জন মৎস্যজীবী। রবিবার সকাল পর্যন্ত তাঁরা নিখোঁজ ছিলেন। দুপুরের দিকে নদীতে ভাসতে থাকা সঞ্জয় দাসের মৃতদেহ উদ্ধার করেন মৎস্যজীবীরা।
সতর্কবার্তা পেয়েও বিপদ বুঝে কেন তাঁরা বিপজ্জনক জায়গায় তাঁদের ট্রলারগুলি ভিড়িয়ে দেন, এই প্রশ্নই ছিল মৎস্যজীবী প্রহ্লাদ দাস, কৃষ্ণ বিশ্বাস, রুদ্র মন্ডলদের কাছে। যখনই সতর্কবার্তা তাঁদের কাছে আসে তখন ঘরে ফিরতে তাঁদেরও মন চায়। মনে পড়ে যায় বাবা-মা আর স্ত্রী-পুত্র পরিবারের কথা। কিন্তু মন চাইলেও ঘরে ফেরা আর তাঁদের হয়ে ওঠে না। কারণ ট্রলার মালিকের সঙ্গে আগেভাগেই তাঁরা চুক্তিবদ্ধ থাকেন। কী সেই চুক্তি? প্রহ্লাদ দাস জানান, চুক্তি দু’রকমের করা হয়। একরকম চুক্তি করা হয় চার মাসের জন্য। সেটা হয় শীতকালে। তাকে বলা হয় ‘সাবার চুক্তি’। এই চুক্তিতে মালিকের সঙ্গে তাঁদের ৪০ হাজার টাকার রফা হয়। চার মাস তাঁরা মালিকের কেনা দাস হয়ে থাকেন।
আরও একরকমের চুক্তি হয় ৯ মাসের জন্য। এটি ‘ফিশিং-চুক্তি’। এই চুক্তিতে ন’মাস কাজের ভিত্তিতে তাঁরা পান ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। মালিকের সব কথা শুনতে হবে। তাই এই সময়ের মধ্যে মন চাইলেও আর ঘরে ফেরা হয় না। যতই তুফান আসুক মালিকের কথায় তখন সমুদ্রের উতাল-পাথাল ঢেউয়ের দোলার মধ্যে পড়েও তাঁদের মাছ ধরে যেতেই হয়। আগেভাগে সতর্কবার্তা পৌঁছালেও ট্রলার কোনওমতেই তখন ঘাটে ভেড়ে না। কাছাকাছি কোনও খাঁড়িতে নোঙ্গর করতে হয়। তা সে যতই বিপজ্জনক হোক না কেন। তুফান কমলে সেই খাঁড়ি থেকেই আবার সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া। এটাই তাঁদের জীবন, এটাই তাঁদের জীবিকা। তাই কেউ ঘরে ফেরে, কেউ ফেরে না।
এফবি চন্দ্রানী ট্রলারে থাকা নিখোঁজ আরও দুই মৎস্যজীবী শেখ মুজিবর রহমান (৩৬) ও অসিত ভূঁইয়ার (৩৩) মৃতদেহ সোমবার উদ্ধার হয়। এখনও নিখোঁজ ওই ট্রলারের আরও ৬ মৎস্যজীবী। সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা এ ব্যাপারে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, মৎস্যজীবীদের কথা অনেকাংশেই সত্য। অধিক লাভের আশায় ট্রলার মালিকদের এহেন অমানবিকতা মোটেই বরদাস্ত করা হবে না। দুর্ঘটনাগ্রস্ত চন্দ্রানী ট্রলারের মালিক দুলাল দাসকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলেও তিনি জানান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.