রমেন দাস: এবার কি ঘুরে দাঁড়াবে বাম দলগুলি? দেশজুড়ে শুরু হওয়া নির্বাচনে এবার কি কিছুটা মাটি ফিরে পাবে তারা? লোকসভা নির্বাচনের মাঝে নেহাৎ বোকার মতো এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়া হয়তো কিছুটা হতাশার। হয়তো এসবে আমল দেওয়ার মতো কোনও কারণ খুঁজে পাবেন না দক্ষিণপন্থীরা। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সংসদীয় রাজনীতিতে বামেদের (Left Front) বিরামহীন ক্ষয়ের নিরিখে সেটাই স্বাভাবিক হয়তো। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অনন্ত উপেক্ষা দিয়েও বামশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাচ্ছে কি? লাল পার্টির ভোটব্যাঙ্ক তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে, সত্যি। রাজ্যে বহুকাল হল, প্রধান বিরোধী দলের তকমাও মুছে গিয়েছে, তাও সত্যি। দেশে শিবরাত্রির সলতে কেরলে টিমটিম করা ক্ষীণপ্রভ পিনারাই বিজয়ন সরকারকে বাদ দিলে নিকষ কালো ও দুর্ভেদ্য অন্ধকারই সাম্প্রতিক হাল, সেটাও সত্যি। পাশাপাশি এই সত্যিও অনস্বীকার্য যে, এই ঘনঘোর দুর্দিনে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঝুঁকিকে তোয়াক্কা না করে দিকে দিকে নির্বাচনী ময়দানে অবতীর্ণ বাম প্রতিনিধিরা। প্রতিবারের মতো এবারও। বামব্যূহের সেই বিপরীত সত্যের ছবি একেবারে ‘গ্রাউন্ড জিরো’ থেকে তুলে আনল ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল’।
একসময় শ্রেণিসংগ্রাম, বুর্জোয়াদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে প্রোলেতারিয়েতদের হাতে তা তুলে দেওয়া, যৌথ খামারের স্বপ্ন দেখা থেকে যে আন্দোলন তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে রাজনীতির অন্দরে ঢুকে মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে। অতি বড় বামপন্থী (Left Front) সমর্থকও তা বোধহয় অস্বীকার করবেন না। ‘শ্রেণিহীন সমাজের চিরবাসনায়’ আশা জাগিয়ে একসময় ক্ষমতায় এসেছিল তারা। তার পর সময়ের চাকা গড়িয়েছে বহুদূর। ‘আশা’ ধীরে ধীরে পর্যবসিত হয়েছে ‘ছলনা’য়। পরিণামে এ রাজ্যের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে তাদের। ফিরে আসা দূর অস্ত, ধীরে ধীরে শূন্য হয়েছে একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ বামেদের আসন। এই বাস্তব পরিস্থিতি স্বীকার করেও তাহলে কীসের শক্তিতে আজও বাম প্রার্থীরা নির্বাচনী যুদ্ধে নামছেন? কোন মনোবলে সম্ভব হচ্ছে লড়াই? সৈনিকরা বলছেন, ‘আদর্শই বড় জোর, মানুষের পাশে থাকার জন্যই রাজনীতি করা। বামপন্থীদের আদর্শকে আজও ভয় পায় ক্ষমতাশালী দক্ষিণপন্থীরা।’
রাজ্যের অন্যতম হাইভোল্টেজ কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের (Diamond Harbour) সিপিএমের তরুণ প্রার্থী প্রতীক-উর রহমান (Pratik Ur Rahaman)। বামেদের ক্ষয়িষ্ণু সময়ে কেন এত কঠিন রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামলেন এসএফআই-এর (SFI) প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি? প্রতীক-উরের জবাবে কিন্তু খেলছে ‘কার তাতে কী?/ আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি’র সুর। তিনি বলছেন, ”জেতা-হারা এমন সরলরৈখিক ব্যাপার নয়। সিপিএমের হার কে ঠিক করল? মানুষ ঠিকমতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে কে হারবে, কে জিতবে দেখা যাক। ডায়মন্ড হারবারের মধ্যে ৬ টি বিধানসভা এলাকার মানুষ ঠিকমতো ভোটই দিতে পারেনি গত ১০ বছরে। এবার মানুষ মুখিয়ে রয়েছে ভোট দিতে। সমুদ্র উত্তাল হলে তবেই তো মাটির জোর প্রমাণ হয়। আমি গর্বিত যে দলের কঠিন সময় কঠিন আসনে আমি প্রার্থী হয়েছি। আমি ছাত্রজীবন থেকে বামপন্থী রাজনীতি করছি। এত মার খেয়েছি যে মরে যেতে পারতাম, খুনও হতে পারতাম সুদীপ্ত, মইদুলদের মতো। আসলে ওরা আমাদের ভয় পায়। ব্যক্তি প্রতীক-উর বা ব্যক্তি সুদীপ্তদের নয়, ওরা আমাদের আদর্শকে ভয় পায়, তাই মারে। তাতেই তো রাজনীতির মজা। আর আমি সমাজব্যবস্থা পালটানোর স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নের জোর আছে।”
হাওড়া (Howrah) লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় (Sabyasachi Chatterjee) । পেশায় আইনজীবী, নেশায় বামপন্থা। কিন্তু স্রেফ নেশার টানেই কি প্রার্থী হলেন? নাকি অন্য কোনও ফ্যাক্টর? এর জবাবে প্রার্থী বলছেন, ”শেষপর্যন্ত তৃণমূল, বিজেপির গুন্ডাদের পরাস্ত করতে হবে। দুজনই হিন্দুত্বের দালাল। কেউ ধর্মীয় মৌলবাদের নামে, কেউ আবার রামনবমীর মিছিল নিয়ে রাজনীতি করছে। এদের না রুখতে পারলে বাংলা মরে যাবে। উৎসাহ নয় কিছু, এটা স্বাভাবিক লড়াই। বামেরা জিতলে মানুষের উপকার হবে। আর কেউ মানুষের উপকার করে না, সবাই দালালি করে। এটা মানুষকে বুঝতে হবে।”
সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় (Sayan Banerjee) তরুণ আইনজীবী। তিনি তমলুক (Tamluk) আসনে সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন। প্রতীক-উরের মতো এত স্বপ্ন দেখা মানুষ সায়ন নন। তিনি বোঝেন কাঠ বাস্তব। লড়াই নিয়ে সায়নের বক্তব্য, ”সীমাহীন দুর্নীতি তৃণমূলের। দেশে বিজেপি সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে দেশ চালাচ্ছে। দেশ বাঁচাতে হলে লাল পতাকাই বিকল্প। সিপিএম হাতে করে নতুন প্রজন্ম তৈরি করেছে, ভোটের ময়দানে তাদের লড়াইয়ে নামিয়েছে। মানুষের জন্য কাজ করে সিপিএম। আর তৃণমূল কী করেছে? চোরদের তৈরি করেছে। এই শিক্ষা দুর্নীতিতে কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো যুব নেতারা জেলে।”
জেএনইউ-র প্রাক্তন ছাত্রনেত্রী দীপ্সিতা ধর (Dipsita Dhar) প্রথমবার লোকসভা ভোটের (Lok Sabha Election) লড়াইয়ে নেমেছেন। শ্রীরামপুর (Serampore) কেন্দ্রের প্রার্থী তিনি। বরাবর স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করেন। কেন এই অসময়ে কাস্তে-হাতুড়ি-তারা হাতে লড়াইয়ে দীপ্সিতা? জবাবে বললেন, ”রোজ সুদীপ্ত গুপ্ত, মইদুল মিদ্যা, স্বপন কোলেদের মতো তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় প্রতিনিধিরা খুন হচ্ছে। তাদের রক্তে লাল হয়েছে আমাদের পতাকা। আমরা ওদের বিচার চাই। ওদের কষ্ট, অধরা স্বপ্ন আমাদের শান্তিতে থাকতে দেয় না। ওদের ইনসাফের জন্য আমাদের প্রজন্ম রাজনীতির লড়াইয়ে নেমেছে। যত দূর যেতে হয়, যাব।”
সেলুলয়েড, থিয়েটারের জনপ্রিয় মুখ দেবদূত ঘোষ (Debdut Ghosh) বরাবর বামপন্থী বলে পরিচিত। ভোট ময়দানে লাল শিবিরের অন্যতম সৈনিক। এবার তিনি লড়বেন ‘কুরুক্ষেত্র’ বারাকপুর (Barrackpore) থেকে। একুশের বিধানসভার লড়াইয়ে টালিগঞ্জ থেকে লড়েছেন দেবদূত। এবার লোকসভার প্রার্থী। শূন্য হয়েও এত শক্তির উৎস কী? ‘সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল’ তাঁর কাছেও একই প্রশ্ন করেছিল। দেবদূতবাবু খোলসা করেই বললেন, ”আমি এখন জনাকীর্ণ সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে আপনাকে উত্তর দিচ্ছি। এখন আমরা শূন্য, কিন্তু আমাদের একটা গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে। ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। আমাদের সমষ্টিগত রাজনীতি, সমষ্টির জন্য লড়াই। আর লড়াই কঠিন না হলে আনন্দ কই? মোদি যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন, তা ঠিকাদারদের মতো। সেনাদেরও অগ্নিবীর প্রকল্পে চার বছরের জন্য নিয়োগ করা হবে। বাংলায় শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির পাশাপাশি শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর বিনিময়ে ন্যূনতম অর্থ পাওয়া যায়, যা জীবনধারণের ক্ষেত্রে অবাস্তব। সবাই তো একটু ভালো জীবনযাপন চায়। রাজ্যে চাকরির ভবিষ্যৎ এত খারাপ যে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সি মানুষ জীবিকার জন্য ভিনরাজ্যে, এখানে আর থাকেন না। এই অবস্থায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারব না।” ফলে সবার কথাতেই স্পষ্ট, বাম আদর্শই লড়াইয়ের মূল মন্ত্র।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.