শংকরকুমার রায়, রায়গঞ্জ: ২৪ নদীতে ঘেরা উত্তর দিনাজপুরে একটিই লোকসভা আসন-রায়গঞ্জ। বাম-কংগ্রেসে শক্তঘাঁটি এখন বিজেপির দখলে। তবু মেটেনি সমস্যা। নেই পর্যাপ্ত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, সড়কের অবস্থা তথৈবচ। আয়ের উপায় বলতে শুধুমাত্র চাষবাস। শিল্পের দেখা নেই। বাম-কংগ্রেসের হাত থেকে ২০১৯-এ রায়গঞ্জ কেড়ে নেয় বিজেপি। তার পরেও খুব একটা বদলায়নি অবস্থা। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই জেলায় ২০২৪-এ কি পালাবদল হবে নাকি ফের ফুটবে পদ্ম? এত বছরের ইতিহাস মুছে জোড়াফুল ফোটাতে পারবে তৃণমূল?
লোকসভার পরিচয়
জেলাজুড়ে বয়ে গিয়েছে একাধিক নদী। সংখ্যা প্রায় ২৪-টা। স্বাধীনতার পর থেকে একটাই শিল্প ছিল এলাকায়-স্পিনিং মিল। বাম আমলের শেষ থেকে টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। আয়ের উপায় চাষবাস আর সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মসংস্থান। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়েছেন, জেলায় গড়ে উঠবে বস্ত্র হাব। সেই আশায় বুক বাঁধছে জেলার বাসিন্দার। এই জেলার বিশেষত্ব বলতে তুলাইপাঞ্জি চাল আর খন গান। তুলাইপাঞ্জি জিআই আদায় করতে পারলেও বিলুপ্তির পথে খন গান। তবে এখনও প্রতিবছর বর্ষায় কুলিক পাখিরায়লয়ের পরিযায়ী পাখি দেখতে ভিড় জমা বহু পর্যটক ও পক্ষীপ্রেমীরা। সেই জেলার এই রায়গঞ্জ লোকসভার অন্তর্গত সাত বিধানসভা-ইসলামপুর, গোয়ালপোখর, চাকুলিয়া, করণদিঘি, হেমতাবাদ, কালিয়াগঞ্জ এবং রায়গঞ্জ। সবমিলিয়ে মোট ৯ ব্লক। তবে জেলার ইটাহার পড়ে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রে এবং চোপড়া পড়ে দার্জিলিং কেন্দ্রের মধ্যে।
জনবিন্যাস
উত্তর দিনাজপুর জেলায় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা অনেকটাই বেশি। প্রায় ৫২ শতাংশ। হিন্দুরা ৪৮ শতাংশ। অথচ রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে উলটপুরাণ। হিন্দু জনসংখ্যাই বেশি-৫১ শতাংশ। সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ৪৯ শতাংশ। তফসিলি জাতি ২৯ শতাংশ, তফসিলি উপজাতি ৭ শতাংশ। মতুয়া ৩৫ শতাংশ।
লোকসভায় পালাবদলের ইতিহাস
প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির আমলে রায়গঞ্জ কংগ্রেসের শক্তঘাঁটি ছিল। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত কংগ্রেস জিতেছে এই আসনে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, তাঁর স্ত্রী মায়া রায় রায়গঞ্জের সাংসদ ছিলেন। ১৯৭৭ সালে প্রথমবার পালাবদল হয়। সাংসদ হন জনতা দলের মহম্মদ হায়াত আলি। আবার পর পর তিনবার কংগ্রেসের দখলে যায় রায়গঞ্জ। কিন্তু সেই ইতিহাস বদলে দেন বাম প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সাংসদ। এর পর উপনির্বাচনে ১৯৯৯ সালে জয়ী হন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। ২০০৯ পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সরে যান রাজনীতি থেকে। সেই সময় বিধায়ক ছিলেন তাঁর সহধর্মিনী দীপা দাশমুন্সি। বিধায়ক পদের মেয়াদ পূর্ণ না করেই লোকসভার প্রার্থী হন দীপা। জিতেও যান। পরের ৫ বছর সাংসদ ছিলেন তিনি। কিন্তু ‘প্রিয়দা’-র সেই ক্যারিশমা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন তাঁর সহধর্মিনী। ফলে কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য। গড় কালিয়াগঞ্জেও মুখ থুবড়ে পরে হাত শিবির। সংগঠনে ক্ষয় ধরে। সেই সুযোগে ২০১৪ সালে সাংসদ হন সিপিএমের মহম্মদ সেলিম। ২০১৯ সালে আসনটি ছিনিয়ে নেন বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী।
গত এক দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস
প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি ও দীপা দাসমুন্সির গড় হিসেবে পরিচিত রায়গঞ্জে ২০১৪ সালে যখন মহম্মদ সেলিম জিতলেন, মনে করা হয়েছিল উত্তরে অক্সিজেন পাবে বাম সংগঠন। কিন্তু কোথায় কী! বামেদের যে জেলা সম্পাদক ভিত্তিক সংগঠনের কাঠামো ছিল, তা কার্যত ভেঙে যায়। যার সুযোগ নিয়ে ২০১৭ সালে পুরভোটে কার্যত একচেটিয়া ভোট করায় তৃণমূল। সব ওয়ার্ড দখল করে তারা। অভিযোগ, মারাত্মক সন্ত্রাস হয়েছিল পুর নির্বাচনে। নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারায় ফুঁসছিল এলাকার বাসিন্দারা।
আমজনতার সেই ‘রাগ’ প্রতিফলিত হয় ২০১৯ সালের ভোটবাক্সে। ৫৭ বছরের ইতিহাস ওলটপালট করে দেন দেবশ্রী চৌধুরী। ৪৯ হাজারের বেশি ভোটে জয়লাভ করেন তিনি। পঞ্চায়েত এবং বিধানসভা ভোটে সেই হিসেব কিছুটা ওলটপালট হয়েছে। একুশের বিধানসভায় কালিয়াগঞ্জ-বিজেপি, রায়গঞ্জ-বিজেপি, হেমতাবাদ-তৃণমূল, করণদিঘি-তৃণমূল, চাকুলিয়া-তৃণমূল, গোয়ালপোখর-তৃণমূল, ইসলামপুর-তৃণমূল জয় লাভ করে। সেই নিরিখে এবার লোকসভা ভোটে এগিয়ে থাকার কথা তৃণমূলের। কিন্তু লাগাতর গোষ্ঠাদ্বন্দ্বের জেরে প্রা৪থী খুঁজে পাওয়াই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল জোড়াফুল শিবিরের কাছে। তবে খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই বিজেপিও। গোটা রায়গঞ্জে পদ্মশিবিরের সংগঠন নড়বড়ে। বহু জায়গায় বুথস্তরে কমিটি নেই। তবে রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর থেকেই জেলাজুড়ে গেরুয়া হাওয়া বইছে। বহু ক্ষেত্রে বাড়ির পুরুষরা বাম-তৃণমূলের পতাকা ধরলেও বাড়ির মহিলারা কিন্তু বিজেপির উপর ভরসা রাখছে। আর তা মূলত হয়েছে হিন্দুত্বের হাওয়ার ভিত্তিতেই।
সম্ভাব্য প্রার্থী
তৃণমূল ইতিমধ্যেই প্রার্থী হিসেবে বিজেপি থেকে আসা কৃষ্ণ কল্যাণীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছে। কিন্তু বিজেপি এখনও প্রার্থী দিতে পারেনি। মনে করা হচ্ছে, বিদায়ী সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরীকে প্রার্থী নাও করতে পারে গেরুয়া শিবির। সেক্ষেত্রে ভূমিপুত্ররা টিকিট পেতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। আবার বাম-কংগ্রেস জোট হলে প্রার্থী হতে পারেন কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সি বা ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে কংগ্রেসে আসা প্রাক্তন বিধায়ক আলি ইমরান রামজ (ভিক্টর)।
সম্ভাবনা
ত্রিমুখী লড়াই দেখবে রায়গঞ্জ। তৃণমূলের কৃষ্ণ কল্যাণীকে দলেরই অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষ করে তাঁর ‘দলবদলু’ ভাবমূর্তি নিয়েও বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কানাইয়ালাল আগরওয়ালকে প্রার্থী না করায় দলেরই একাংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। বিধায়ক আবদুল করিম চৌধুরীও খুশি নন। ফলে তৃণমূলের লড়াইটা বেশ কঠিন হতে চলেছে। অন্যদিকে বিজেপির সংগঠনের অবস্থা ভালো নয়। এবার নির্বাচনে ফ্যাক্টর হতে পারে হিন্দু-মুসলিম ভোট কাটাকাটি। রামমন্দিরের জিগির তুলে হিন্দু ভোট পকেটে পুড়তে পারে গেরুয়া শিবির। সংখ্যালঘু ভোট অনেকটাই তৃণমূলের দিকে আসার কথা। কিন্তু ভিক্টর প্রার্থী হলে মুসলিম ভোট অনেকটাই তাঁর পকেটে আসবে। আর এই ভোট কাটাকাটির ফায়দা তুলতে পারে বিজেপি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.