বাবুল হক, মালদহ: উত্তরে প্রিয়রঞ্জন, দক্ষিণে বরকত গনি খান। একটা সময় কার্যত এই দুই ভাগেই বিভক্ত ছিল মালদহ জেলার রাজনীতি। গনি আর প্রিয়রঞ্জন, দু’জনেই ছিলেন কংগ্রেসের। উত্তর মালদহের খরবা (চাঁচোল), হরিশ্চন্দ্রপুর ও রতুয়া এলাকা তখন রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল। গাজোল ছিল বালুরঘাটের। আর মালদহ জেলার বাকি এলাকা নিয়ে গঠিত মালদহ লোকসভা কেন্দ্রটি বরাবরই দখলে ছিল কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা এ বি এ গনি খান চৌধুরির। রায়গঞ্জের বর্ষীয়ান নেতা প্রিয়রঞ্জন চাষ করতেন মালদহের উত্তরাংশের ওই তিন বিধানসভা এলাকা।
২০০৯ সালে নতুনভাবে আসন পুনর্বিন্যাসের জেরে মালদহ ভেঙে গঠিত হয় মালদহ উত্তর এবং মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্র। রায়গঞ্জ লোকসভা এলাকা থেকে বেরিয়ে এসে মালদহ উত্তর কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত হয় (খরবা) চাঁচোল, হরিশ্চন্দ্রপুর আর রতুয়া। বালুরঘাট থেকে বেরিয়ে আসে গাজোল। খরবা আর আড়াইডাঙা বিধানসভা কেন্দ্র কার্যত বদলে যায় চাঁচোল আর মালতিপুরে। যোগ হয় মালদহ আর হবিবপুর বিধানসভা কেন্দ্র। মোট সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত হয় মালদহ উত্তর লোকসভা আসন। এখন গনি নেই, প্রিয়ও নেই। তবু মালদহ উত্তর কংগ্রেসের ‘দুর্গ’ হিসাবে অটুট ছিল আরও দশটি বছর। ২০০৯ সালে নতুন কেন্দ্র গঠন হতেই কংগ্রেসের প্রতীকে মালদহ উত্তরে জয়লাভ করেছিলেন গনির ভাগ্নি মৌসম বেনজির নুর। ২০১৪ সালেও হাত প্রতীকে সাংসদ নির্বাচিত হন মৌসম। কিন্তু উনিশের লোকসভা নির্বাচনে ঘটে যায় অঘটন। হাত ছেড়ে ঘাসফুল প্রতীকে প্রার্থী হতেই মালদহ উত্তর হাতছাড়া হয় মৌসমের। ত্রিমুখী লড়াইয়ের ভোট ভাগাভাগিতে জয়লাভ করেন বিজেপির খগেন মুর্মু। একদা কংগ্রেসের দুর্ভেদ্যঘাঁটি ঢাকা পড়ে যায় গেরুয়া আবরণে। এবার কি রঙবদল ঘটবে? নাকি ফের ত্রিমুখী লড়াইয়ের কাঁধে ভর করে বৈতরণী পার হবেন খগেন?এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন।
জনবিন্যাস
মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের জনসংখ্যা ২৩ লক্ষ ১২ হাজার ৫৮৪। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৩ শতাংশ গ্রামে এবং প্রায় ৭ শতাংশ শহরে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম, ৮ শতাংশ তফসিলি জাতি, ৬ শতাংশ তফসিলি উপজাতি এবং ৪৪ শতাংশ সাধারণ হিন্দু। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মালদহ উত্তর কেন্দ্রে ভোটদাতার সংখ্যা ছিল ১৪ লক্ষ ২৫ হাজার ৪২৮। সাক্ষরতার হার প্রায় ৫৮ শতাংশ।
ইতিহাস
মালদহ লোকসভা আসনটি স্বাধীনতার পর থেকে বরাবরই কংগ্রেসের দখলে ছিল। মাত্র দু’বার জিতেছিল সিপিএম। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পরপর চারবার কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। অঘটন ঘটে ১৯৭১ সালের নির্বাচনে। ওই বছর কংগ্রেসের কাছ থেকে আসনটি কেড়ে নেন সিপিএম প্রার্থী দীনেশ জোয়ারদার। ১৯৭৭ সালেও বামপ্রার্থী দীনেশবাবু জয়লাভ করেন। তার পর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে এই মালদহ লোকসভায় প্রার্থী হন কংগ্রেস নেতা এ বি এ গনি খান চৌধুরি। তিনি জয়লাভ করে দিল্লির মসনদ-তক পৌঁছে যান। ১৯৮০ সাল থেকে আমৃত্যু ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা আটবার সাংসদ নির্বাচিত হন বরকত গনি খান চৌধুরি। তার পর ২০০৯ সালে মালদহ উত্তর কেন্দ্র তৈরি হয়। নতুন এই কেন্দ্রে জয়লাভ করেন কংগ্রেসের মৌসম নুর। ২০১৪ সালেও তিনি জয়লাভ করেন। ২০১৯ সালে মালদহ উত্তর আসনটি দখল করে বিজেপি। সাংসদ হন খগেন মুর্মু।
গত এক দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২০০৯ লোকসভা নির্বাচনেও ট্র্যাডিশন বহাল ছিল। সংখ্যালঘু ভোটের দৌলতে জয়লাভ করে কংগ্রেস। জিতেছিলেন কংগ্রেসের মৌসম নুর। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী মৌসম বেনজির নুর জেতেন। তার পর ধীরে ধীরে কংগ্রেস ও বামেদের শক্তিক্ষয় হয়েছে। উত্থান ঘটে বিজেপির। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে এক নম্বর স্থানে পৌঁছে যায় তৃণমূল। কংগ্রেস এবং সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনেই সিপিএমকে পিছনে ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেসের কিছুটা উত্থান ঘটে। উত্তর থেকে চারটি জেলা পরিষদের আসন পায় কংগ্রেস। বিজেপি পায় চারটি জেলা পরিষদের আসন। ১৪টি পঞ্চায়েতের বোর্ড দখল করে বাম-কংগ্রেস জোট। একটি পঞ্চায়েত সমিতিও দখল করেছে। ১৮টি পঞ্চায়েত ও একটি সমিতির দখল নিয়েছে বিজেপি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সাতটির মধ্যে তিনটি বিজেপি এবং চারটি তৃণমূলের দখলে রয়েছে। কংগ্রেসের কোনও বিধানসভা দখলে নেই। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী খগেন মুর্মু পান ৫ লক্ষ ৯ হাজার ৫২৪ ভোট অর্থাৎ ৩৭.৬১ শতাংশ ভোট। তৃণমূলের মৌসম নুর পান ৪ লক্ষ ২৫ হাজার ২৩৬ অর্থাৎ ৩১.৩৯ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস প্রার্থী ইশা খান চৌধুরি পান ৩ লক্ষ ৫ হাজার ২৭০ ভোট। অর্থাৎ ২২.৫৩ শতাংশ ভোট। সিপিএম প্রার্থী বিশ্বনাথ ঘোষ পান ৫০৪০১ ভোট অর্থাৎ মাত্র ৩.৭২ শতাংশ ভোট। স্বভাবতই দেখা যাচ্ছে তৃণমূল ও কংগ্রেসের ভোট ভাগাভাগির জেরেই প্রায় ৭৫ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন বিজেপি প্রার্থী খগেন মুর্মু। এবারও সেই ত্রিমুখী লড়াইয়ের কাঁধে ভর করে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী খগেন মুর্মু জয়লাভের স্বপ্ন দেখছেন। শুধু তা-ই নয়, আসাউদ্দিন ওয়েসির ‘মিম’ এই কেন্দ্রে এবার প্রার্থী দিয়ে সংখ্যালঘু ভোট তছনছ করতে প্রস্তুত হচ্ছে বলে খবর। তাতে গেরুয়া শিবিরের জয়ের পথ আরও মসৃণ করতে পারে মিম। এটাও এবার ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে।
হালফিলের হকিকত
২০১১ সালে রাজ্যে সরকারে পালাবদলের পর বুথ স্তরেও তৃণমূলে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। অনেকটা দ্রুতগতিতেই সিপিএমের সংগঠন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মুছে যায় কংগ্রেসের বুথ কমিটিও। বরকত গনি খান চৌধুরির নাম ভাঙিয়েও দলত্যাগের হিড়িক রুখতে পারেনি কংগ্রেস। ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বাম-কংগ্রেস কার্যত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। তৃণমূল এক নম্বর স্থানে উঠে আসে। কংগ্রেস ও সিপিএমকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান দখল করে বিজেপি। ওল্ড মালদহ পুরসভার দখল নেয় তৃণমূল। সেখানেও দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে যায় বিজেপি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে হবিবপুর, গাজোল ও মালদহ কেন্দ্রে বিজেপি জয়লাভ করে। বাকি মালতিপুর, চাঁচোল, হরিশ্চন্দ্রপুর ও রতুয়া, এই চারটি আসনে জেতে তৃণমূল। ফলে হালফিলের হকিকত বলছে, বিজেপি আরও কিছুটা শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে উত্তর মালদহে। আদিবাসী অধ্যুষিত গাজোল, হবিবপুর ও ওল্ড মালদহ, এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্র বরাবরই ‘সিপিএম দুর্গ’ হিসাবে খ্যাত ছিল। কিন্তু লালদুর্গ আর নেই। দূরবীন দিয়েও দেখা মেলে না বামেদের। তিন কেন্দ্রের রঙ খুব দ্রুত বদলে গিয়েছে গেরুয়া রঙে। আদিবাসী এলাকায় গেরুয়া শিবিরের দ্রুত উত্থান যেমন সিপিএমকে নিশ্চিহ্ন করেছে, তেমনি কংগ্রেসকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে। তবে তৃণমূলের সরকারের সামাজিক প্রকল্পের প্রভাব পড়েছে এলাকায়।
কেন্দ্রের প্রার্থীরা
মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে পুনরায় বিজেপি প্রার্থী করেছে খগেন মুর্মুকে। তবে প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নতুন মুখ এনে চমক দিয়েছে তৃণমূল। এবার তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন আইপিএস প্রসূন বন্দোপাধ্যায়। তিনি মালদহ জেলার পুলিশ সুপার পদে একসময় কর্মরত ছিলেন। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পুলিশ সুপার পদেও কাজ করেছেন প্রসূন বন্দোপাধ্যায়। ডিআইজি পদেও ছিলেন তিনি। নতুন মুখ হলেও প্রার্থী হিসাবে হেভিওয়েট বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে। কংগ্রেস এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি। কংগ্রেসের সম্ভাব্য প্রার্থী হরিশ্চন্দ্রপুরের প্রাক্তন বিধায়ক মোস্তাক আলম।
সম্ভাবনা
উত্তর মালদহ লোকসভা আসনে ভোটের ফলাফল সংখ্যালঘু ভোটের উপর বেশি নির্ভরশীল। পাশাপাশি আদিবাসী ভোটও ফ্যাক্টর। পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলের নিরিখে আসনটিতে তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। তবে সংখ্যালঘু ভোট যত কাটবে কংগ্রেস, ততই লাভবান হতে পারে পদ্ম শিবির।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.