বাবুল হক, মালদহ: গনির গড়ে বরাবরই গনিতেই ভরসা রাখে গনি পরিবার। মালদহ রাজনীতির রহস্য অন্তত এটাই। তবে এবারও কি সেই একই পরম্পরা, একই ট্র্যাডিশন? লাখ টাকার প্রশ্ন। বরকত গনি খান চৌধুরির প্রয়াণের পর কেটে গিয়েছে প্রায় দেড় যুগ। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর নামেই ভোট হয়ে যায়। যা এযাবৎ ঠেকাতে পারেনি কোনও রাজনৈতিক দল। বরকতের সাজানো বাগানে পঞ্চায়েত, পুরসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে কিন্তু ঘাসফুল ভালোই ফুটেছে, সেই সঙ্গে ছিটেফোঁটা হলেও ফুটেছে পদ্মফুলও। কিন্তু লোকসভা ভোট এলেই চিত্রটা ফিরে যায় সেই পুরনো দিনেই। লোকসভা মানেই ‘দিল্লির ভোট’, এই বিষয়টি প্রচারের মাধ্যমে জনে জনে গেঁথে দিয়ে প্রতিবারই সফল হন গনি ভক্তরা। গনির নামেই বারবার ভোট করে কংগ্রেস। প্রতিহত করতে পারেন না কেউই। ফলে আবাহমানকাল ধরেই ‘গনি মিথ’ কার্যত অটুট রয়ে গিয়েছে। মালদহ দক্ষিণ লোকসভা আসনে এবারেও কংগ্রেসের প্রার্থী গনি পরিবারের সদস্য। এটাই যেন ‘প্লাস পয়েন্ট’। কিন্তু দেশ-দশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার নিরিখে এবার কার কথা শুনবেন ভোটাররা? মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে সত্যিই কি গনি মিথ চূর্ণ করে কংগ্রেসের বিজয় রথের চাকা থমকে দিতে পারবে তৃণমূল কিংবা বিজেপি? ত্রিমুখী লড়াইয়ে মিশে আছেন সংখ্যালঘু ভোটাররা। নাগরিকপঞ্জি, সিএএ। বিভাজন ইস্যু এবার অন্তত আশার আলো দেখাচ্ছে তৃণমূলকে। কিন্তু সংখ্যালঘু ভোটের ভাগাভাগির জেরে কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি এবার গেরুয়া আবরণে ঢাকা পড়ে যাবে না তো? উত্তর মিলবে ৪ জুন।
জনবিন্যাস
মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের জনসংখ্যা ২৪ লক্ষ ৮ হাজার ৩৩২। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশ গ্রামে এবং প্রায় ১৫ শতাংশ শহরে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম। অন্যান্য ৪৮ শতাংশ। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে ভোটদাতার সংখ্যা ছিল ১৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ১৪৩। সাক্ষরতার হার প্রায় ৬৪ শতাংশ।
ইতিহাস
মালদহ লোকসভা আসনটি স্বাধীনতার পর থেকে বরাবরই কংগ্রেসের দখলে ছিল। মাত্র দু’বার জিতেছিল সিপিএম। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পর পর চারবার কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। অঘটন ঘটে ১৯৭১ সালের নির্বাচনে। ওই বছর কংগ্রেসের কাছ থেকে আসনটি কেড়ে নেন সিপিএম প্রার্থী দীনেশ জোয়ারদার। ১৯৭৭ সালেও বামপ্রার্থী দীনেশবাবু জয়লাভ করেন। তার পর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে এই মালদহ লোকসভায় প্রার্থী হন কংগ্রেস নেতা এ বি এ গনি খান চৌধুরি। তিনি জয়লাভ করে দিল্লির মসনদ-তক পৌঁছে যান। ১৯৮০ সাল থেকে আমৃত্যু ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা আটবার সাংসদ নির্বাচিত হন বরকত গনি খান চৌধুরি। গনি খানের মৃত্যুর পর ২০০৬ সালে উপনির্বাচনে তাঁর ভাই ডালু ওরফে আবু হাসেম খান চৌধুরি সাংসদ নির্বাচিত হন। তার পর ২০০৯ সালে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্র তৈরি হয়। নতুন এই কেন্দ্রেও জয়লাভ করেন কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরি। ২০১৪ ও ২০১৯ সালেও তিনি জয়লাভ করেন।
গত এক দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২০০৯ লোকসভা নির্বাচনেও ট্র্যাডিশন বহাল ছিল। গনি খান চৌধুরির নামেই জয়লাভ করে কংগ্রেস। জিতেছিলেন কংগ্রেসের ডালু। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরি জেতেন। তার পর অবশ্য ধীরে ধীরে কংগ্রেসের শক্তিক্ষয় হয়েছে। বামেরা কখনও দাঁত গজানোর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি। ২০১১ সালে রাজ্যে সরকারে পালাবদলের পর উত্থান ঘটে তৃণমূলের। কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীদের একটা বড় অংশ তৃণমূলে যোগদান করে ফেলে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে কংগ্রেস কার্যত মুছে যায়। সমিতি-সমেত প্রায় সব পঞ্চায়েত দখল করে তৃণমূল। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেসের কিছুটা উত্থান ঘটে। একটি পঞ্চায়েত পায় আইএসএফ।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সাতটির মধ্যে একটি বিজেপি এবং ছয়টি আসন তৃণমূলের দখলে গিয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু) ৩ লক্ষ ৮০ হাজার ২৯১ ভোট পেয়েছিলেন। অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী বিষ্ণুপদ রায় ২ লক্ষ ১৬ হাজার ১৮০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। সিপিএম প্রার্থী আবু হাসনাত খান ২ লক্ষ ৯ হাজার ৪৮০ ভোট পান। তৃণমূল প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৬৩২। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরি ৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৭০ ভোট পান। বিজেপি প্রার্থী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরি ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৮ এবং তৃণমূলের মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ৩৫৩ ভোট পান। বিজেপি প্রার্থীর চেয়ে মাত্র প্রায় আট হাজার ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেছিলেন কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরি।
হালফিলের হকিকত
২০১১ সালে রাজ্যে সরকারে পালাবদলের পর বুথ স্তরেও তৃণমূলে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। অনেকটা দ্রুতগতিতেই সিপিএমের সংগঠন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মুছে যায় কংগ্রেসের বুথ কমিটিগুলিও। বরকত গনি খান চৌধুরির নাম ভাঙিয়েও মালদহ দক্ষিণে দলত্যাগের হিড়িক রুখতে পারেনি কংগ্রেস। ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বাম-কংগ্রেস কার্যত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। তৃণমূল আধিপত্য বিস্তার করে। ইংলিশবাজার পুরসভার দখল নেয় তৃণমূল। সেখানে অবশ্য দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে যায় বিজেপি। পুরসভায় বাম -কংগ্রেস শূন্য।একুশের বিধানসভা নির্বাচনে মানিকচক, মোথাবাড়ি, বৈষ্ণবনগর, সুজাপুর, ফরাক্কা ও সামসেরগঞ্জ তৃণমূল দখল করে। ইংলিশবাজার বিধানসভায় জয়লাভ করে বিজেপি। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে এই ইংলিশবাজার বিধানসভা এলাকা থেকে তৃণমূলের চেয়ে ৯৬ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিল বিজেপি। এই অঙ্কের হেরফের কী ধরনের হবে, সেটার উপর অনেকটা নির্ভর করছে এই কেন্দ্রের ভোটযুদ্ধ।
প্রার্থী
মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রে পুনরায় বিজেপি প্রার্থী করেছে শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরিকে। তিনি দিল্লিতে থাকেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। সমাজকর্মী। ‘নির্ভয়া দিদি’ হিসাবে পরিচিত। গতবার কংগ্রেসের ডালু ওরফে আবু হাসেম খান চৌধুরির কাছে মাত্র প্রায় আট হাজার ভোটে হেরেছিলেন শ্রীরূপা। তৃণমূল ছিল তৃতীয় স্থানে।
তবে এই কেন্দ্রে এবার নতুন মুখ এনে চমক দিয়েছে তৃণমূল। মালদহ দক্ষিণে এবার তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন শাহনওয়াজ আলি রায়হান। গঙ্গার ভাঙন কবলিত এলাকার ছেলে। কালিয়াচক-২ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত মোথাবাড়ি থানার হামিদপুর পশ্চিম তৌফি এলাকার বাসিন্দা। জন্মভিটেও তৌফি। বাবা অবসরপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ অফিসার। রায়হানের স্ত্রী ইংল্যান্ডের শেফেল শহরের একজন চিকিৎসক। মালদহের ফরাক্কায় এনটিপিসি হাই স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে কলকাতা, রবীন্দ্রভারতী ও জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। তার পর গবেষণা করতে লন্ডনে পাড়ি দেন। একসময় লন্ডনের রাস্তায় কেন্দ্রের মোদি সরকারের এনআরসি এবং সিএএ’র প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন করেছিলেন শাহনওয়াজ।
তবে এবার প্রার্থী তালিকায় রদবদল করেছে কংগ্রেস। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে সুজাপুরে দেড় লক্ষাধিক ভোটে তৃণমূল প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন আবু হাসেম খান চৌধুরির ছেলে ইশা খান চৌধুরি। তাঁকেই এবার লোকসভা নির্বাচনে মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস। কানাডায় শৈশব কেটেছে ইশার। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে স্নাতক তিনি। বিদেশে বাবার ব্যবসা দেখতেন। গনির মৃত্যুর পর ইশাও মালদহের কোতোয়ালিতে ফিরে বংশপরম্পরা রাজনীতিতে নেমে পড়েছিলেন। এবার মালদহ দক্ষিণে হঠাৎ করে ডালুপুত্র ইশা খান কেন প্রার্থী? গনির ভাই ডালু ওরফে আবু হাসেম খান চৌধুরি মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রের চারবারের কংগ্রেস সাংসদ। পঞ্চমবারের জন্য সাংসদ হওয়ার লক্ষ্যে ভোটযুদ্ধে নামতে চেয়েছিলেন সাংসদ ডালু। কংগ্রেসের জেলা নেতৃত্বের দাবি, ডালুর শরীর সঙ্গ দিচ্ছে না। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ডালুবাবুকে এবার টিকিট দেয়নি কংগ্রেস হাইকমান্ড। বাবার মানরক্ষা করতে পারবেন কি ছেলে? প্রশ্ন থাকছেই।
সম্ভাবনা
মালদহ দক্ষিণ লোকসভা আসনে ভোটের ফলাফল সংখ্যালঘু ভোটের উপর বেশি নির্ভরশীল। পঞ্চায়েত ও বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে আসনটিতে তৃণমূল অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। ফ্যাক্টর ডালুর না দাঁড়ানোটাও। কংগ্রেসের ডালু বরাবরই ‘হেভিওয়েট’ বলে পরিচিত। ছেলে ইশার সেই তকমা নেই। তবে সংখ্যালঘু ভোট যত কাটবে কংগ্রেস, ততই ক্ষতি তৃণমূলের। ত্রিমুখী লড়াইয়ে অঘটন ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। হাত আর ঘাসফুলের দড়ি টানাটানিতে পদ্মের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লেও কেউ অবাক হবেন না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.