সঞ্জিত ঘোষ, নদিয়া: চৈতন্য জন্মভূমি নবদ্বীপই স্বাধীনতা পরবর্তী কালে নদিয়া জেলার একমাত্র লোকসভা আসন হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। প্রখ্যাত আইনজ্ঞ লক্ষীকান্ত মৈত্র নবদ্বীপকে জেলার একমাত্র লোকসভা কেন্দ্র হিসাবে নথিভুক্ত করিয়েছিলেন। ছয়ের দশকের শেষের দিকেলোকসভার পুনর্বিন্যাসের ফলে জেলায় দুটি লোকসভা কেন্দ্র তৈরি হয়-কৃষ্ণনগর ও নবদ্বীপ। জেলা উত্তরের কৃষিনির্ভর অঞ্চলগুলি নিয়ে তৈরি হয়েছিল কৃষ্ণনগর কেন্দ্রটি। ১৯৬৭ সালে প্রথমবার এই কেন্দ্রে লোকসভা নির্বাচন হয়। নয়ের দশকের শেষের দিক পর্যন্ত এলাকায় দাপট ছিল বামেদের। পরবর্তীতে এই কেন্দ্র থেকেই উত্থান হয় বিজেপির। এই কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে প্রথম বিজেপি সাংসদ হন। তার পর দেড় দশক ধরে জেলায় ঘাসফুল ফুটেছে। এবারও কি সেই ট্রেন্ডই বজায় থাকবে, নাকি বদলাবে ইতিহাস? এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে এই লোকসভার অন্তর্গত পলাশিপাড়ার বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য জেলবন্দি। বিষয়টি রাজ্য়ের শাসকদলের চিন্তা যে বাড়াবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লোকসভার পরিচয়
নদিয়া জেলার সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত এই লোকসভা কেন্দ্র। এর অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রগুলি হল-
জনবিন্যাস
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন অনুযায়ী, এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ১৬ লক্ষেরও বেশি। এর মধ্যে মুসলিম ভোট ৪০ শতাংশের বেশি। মতুয়া ভোটার রয়েছে ১০-১৫ শতাংশ।
ইতিহাস
১৯৬৭ সালে প্রথমবার লোকসভা ভোটে জয় পেয়েছিলেন নির্দল প্রার্থী হরিপদ চট্টোপাধ্যায়। এর পর ১৯৭১ থেকে ১৯৯৯ টানা আটবার (নির্বাচন -উপনির্বাচন মিলিয়ে) এই কেন্দ্রে জয় পেয়েছিলেন বাম প্রার্থীরা। ১৯৯৯ সালে এই কেন্দ্রে প্রথম পদ্ম ফোটান বিজেপি প্রার্থী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়। যিনি ‘জলুবাবু’ হিসাবে রাজনৈতিক মহলে পরিচিত। জিতে এনডিএ সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি।
২০০৪ সালে ফের এই কেন্দ্রে জেতেন সিপিএম প্রার্থী- জ্যোতির্ময়ী শিকদার। কিন্তু ২০০৯ সালে ঘটে পালাবদল। সে বছর জ্যোতির্ময়ী শিকদারকে হারিয়ে এই কেন্দ্রে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী তথা অভিনেতা তাপস পাল। ২০১৪ সালেও জেতেন তাপস পালই। ২০০৯ সালে তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল সাড়ে ৭৭ হাজারেরও বেশি। সে বছর এই লোকসভার অন্তর্গত সমস্ত বিধানসভাতেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০১৪ সালে ব্যবধান কমলেও জয় পেতে সমস্যা হয়নি তাপস পালের। ৭১ হাজার ভোটে জেতেন তিনি।
২০১৯ সালে তৃণমূল কৃষ্ণনগর থেকে প্রার্থী করেছিল মহুয়া মৈত্রকে। বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবেকে হারিয়ে কৃষ্ণনগর থেকে ৬৫ হাজার ৪০৪ ভোটে জেতেন মহুয়া। যদিও ঘুষ নিয়ে প্রশ্নের অভিযোগে এ বছর তাঁর সাংসদ পদ খারিজ হয়। যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
প্রার্থী পরিচয়
এবারও তৃণমূল মহুয়ার উপরই আস্থা রেখেছে। তাঁকেই প্রার্থী করেছে দল। মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার পর জেলা সভাপতির দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত,
অন্যদিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পরিবারের সদস্য তথা কৃষ্ণনগরের ‘রাজমাতা’ অমৃতা রায়কে প্রার্থী করে চমক দিয়েছে বিজেপি। খোদ প্রধানমন্ত্রী ফোন করে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। এদিকে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক কবজা করতে এসএম সাদিকে প্রার্থী করেছে বামেরা।
হালফিলের হকিকত
১৯৯৯ সালে বিজেপির সাংসদ নির্বাচিত হলেও তার পর থেকে আর এই কেন্দ্রে পদ্ম ফোটেনি। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য ভোটবৃদ্ধি হয়েছিল বিজেপির। তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬ লক্ষ ১৪ হাজার ৮৭২ বা ৪৫ শতাংশ। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির কল্যাণ চৌবে প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫ লক্ষ ৫১ হাজার ৬৫৪ বা ৪০.৩৭ শতাংশ। ২০২১ সালে এই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে ৬টিতেই জেতে তৃণমূল। তবে কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে জয় পায় বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের হয়ে সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তৃণমূলত্যাগী মুকুল রায়। যদিও শারীরিক অসুস্থতার জন্য রাজনীতির আঙিনায় এখন দেখা মেলে না তাঁর। পঞ্চায়েত ভোটে
সম্ভাবনা
কেন্দ্রের মোদিবিরোধী মুখ মহুয়াকে প্রার্থী করলেও দলের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চিন্তা বাড়িয়েছে তৃণমূলের। গলার কাঁটা গ্রামীণ এলাকার বেশকিছু অনুন্নয়নের অভিযোগও। তাছাড়া প্রার্থী মহুয়ার ‘অ্যাটিটিউড’ নিয়েও দলীয় কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এমনকী, প্রার্থী নিয়েও দলের অন্দরে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। এদিকে নিয়োগের নামে টাকা তোলার অভিযোগে জেলবন্দি পলাশিপাড়ার বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যে। সূত্রের খবর, তাঁর বিরুদ্ধে এলাকায় তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। যার প্রতিফলন হতে পারে ভোটবাক্সে। তবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে পুঁজি করে মহিলা ভোট একচেটিয়া নিজেদের দিকে টানতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল। সংখ্যালঘু ভোটও তাঁদের দিকে থাকবে বলেই মনে করছে নিচুতলার নেতারা
এদিকে ভোটের আগে CAA লাগু করে মতুয়া ভোট নিজেদের দিকে টানতে চায় গেরুয়া শিবির। তবে রাজ্যের শাসকদল যেভাবে বিরুদ্ধ প্রচার শুরু করেছে, তাতে বিজেপি কতটা লাভ ঘরে তুলতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এদিকে প্রার্থী নিয়ে দলের অন্দরেও ক্ষোভ রয়েছে। তবে শেষ মুহুর্তে প্রচারের ঝড় তুলে বিজেপির দিকে ভোট টানতে পারবে বলেই আত্মবিশ্বাসী গেরুয়া শিবিরও।
অন্যদিকে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়েছে বামেরা। যার ফলে সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগি হতে পারে। এর প্রত্যক্ষ ফল কি পাবে বিজেপি, সেটাই এখন দেখার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.