সুনীপা চক্রবর্তী, ঝাড়গ্রাম: জঙ্গলমহল ঝাড়গ্রাম (Jhargram) একসময়ে মাওবাদী আতঙ্কে কাঁপত। শাল-পিয়াল-মহুল গাছের ফাঁকে ফাঁকে জলপাই পোশাকে ছদ্মবেশে বন্দুক চালানোর মহড়া চলত। কতশত মানুষেরই না ‘কড়া বিচার’ হয়েছে তাদের গণ আদালতে! কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আতঙ্কের ছবি আজ উধাও ঝাড়গ্রামের বুক থেকে। রাজ্য সরকারের হাজার উন্নয়নমূলক প্রকল্পের হাত ধরে চেহারা বদলেছে। শুধু ঝাড়গ্রাম নয়, বাংলার জঙ্গলমহল এখন সদা হাস্যময়। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটেছে। বদলেছে রাজনৈতিক সমীকরণও। বাম আমলের শেষ দিকে যথেষ্ট আতঙ্কের পরিবেশে ঝাড়গ্রামে নির্বাচন হতো। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস নেই বলে মাওবাদীরা তখন ভোট বয়কটের ডাক দিত এবং তাতে শামিল হতে জনগণের উপরও চাপ থাকত। আর এখন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটের লাইনে দাঁড়ান। চব্বিশের লোকসভা ভোটেও (Lok Sabha Election 2024) ঝাড়গ্রামে জমজমাট লড়াই। প্রার্থীরা সকলে স্বপ্রতিষ্ঠিত। কেমন হতে চলেছে এবারের নির্বাচন, দেখে নেওয়া যাক।
রাজনৈতিক ইতিহাস
১৯৬২ সাল থেকে ঝাড়গ্রামে লোকসভা ভোট হয়। এই কেন্দ্র তফসিলি উপজাতি (ST) সংরক্ষিত। প্রথমবার কংগ্রেসের দখলে গিয়েছিল ঝাড়গ্রাম। সাংসদ হন সুবোধচন্দ্র হাঁসদা। ১৯৭৭ থেকে টানা ২০১৪ সাল পর্যন্ত একচেটিয়া বামেরাই ঝাড়গ্রামের রাজনৈতিক জমিতে লাল ঝান্ডা উড়িয়েছিল। তার পর থেকে এই জমির রং বদলাতে থাকে। কখনও সবুজ, কখনও গেরুয়া। এবার চতুর্মুখী লড়াই – তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম (CPM) এবং আইএসএফ।
জনবিন্যাস
জঙ্গলমহল ঝাড়গ্রামে মূলত আদিবাসী এলাকা। একাধিক জাতি-উপজাতির বাস। মোট ভোটার ১৭,৭৭,৩৬৭ জন। মহিলা ভোটারের সংখ্যা ৮,৮৮,৩৩৫। আর পুরুষ ভোটার ৮,৮৯,০১২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা মাত্র ২০। ৮৫ বছরের বেশি বয়স্ক ভোটার রয়েছেন ১০,৫৭৬ জন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ভোটার ৭,০৫৩।
বিধানসভা কেন্দ্র
ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে ডিলিমিটেশনের ফলে বিধানসভা কেন্দ্র অদলবদল হয়েছে। আগে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল – গড়বেতা পূর্ব, গড়বেতা পশ্চিম (এসসি), শালবনি, নয়াগ্রাম (এসটি), গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম ও বিনপুর। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের আওতায় থাকা ৭ বিধানসভা কেন্দ্র –
অতীত নির্বাচনের ফলাফল
১৯৬২ সালে প্রথম ভোটে কংগ্রেসের (Congress) দখলে গিয়েছিল ঝাড়গ্রাম। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন বাংলা কংগ্রেস ও তার পরবর্তী বছর ফের কংগ্রেস জিতেছিল এই কেন্দ্র থেকে। ১৯৭৭ সাল থেকে সিপিএমের সাংসদ পান ঝাড়গ্রামবাসী। যদুনাথ কিস্কু হন সাংসদ। তার পর থেকে টানা ৩ বার মতিলাল কিস্কু ও পাঁচবার রূপচাঁদ মুর্মু ভোটে জিতে লোকসভায় যান। ২০১৪ ও ২০১৯-এ তৃণমূল ও বিজেপির সাংসদ হন।
হালফিলের হাল-হকিকত
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্র থেকে জিতে সাংসদ হন বিজেপির (BJP) কুনার হেমব্রম। তবে তিনি চব্বিশের লোকসভা ভোট ঘোষণা হওয়ার আগেই দলত্যাগ করেন। সেবার গেরুয়া ঝড়ে জঙ্গলমহলের এই জেলায় পদ্ম ফুটলেও তার পর থেকে গেরুয়া রং ফিকে হতে থাকে। পরবর্তী সবকটি নির্বাচনে রাজ্যের শাসকদলই জয়পতাকা উড়িয়েছে। ৭ বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে সাতটিই তৃণমূলের। ৭৯ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে সাতটি কুড়মিদের দখলে। বাকি সবেতে ঘাসফুল ফুটেছে। পঞ্চায়েত ভোটে একটিতেও পদ্ম ফোটেনি। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের পর থেকে কোনও নির্বাচনেই আর সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি বিজেপি। নেপথ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের একাধিক সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প।
চব্বিশের সম্ভাবনা
এবারের লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রামের তৃণমূল (TMC) প্রার্থী সাঁওতালি ভাষার বিশিষ্ট সাহিত্যিক, পদ্মশ্রী প্রাপ্ত কালীপদ সোরেন। বিজেপির হয়ে লড়বেন চিকিৎসক প্রণোৎ টুডু। এলাকার অন্যতম বিশিষ্ট ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আর সিপিএম প্রার্থী সোনামণি মুর্মু টুডু। পিছিয়ে পড়া এলাকার মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার শিখিয়ে সামাজিক বিপ্লব আনা সোনামণি লাল শিবিরের হয়ে এবার দিল্লির লড়াইয়ে। যাঁর রাজনৈতিক জীবনে এখনও পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে হারের কোনও নজির নেই। এই ত্রয়ীর মাঝে ভোট কাটাকাটির খেলায় ময়দানে নেমেছেন আইএসএফ প্রার্থী বাপি সোরেন। ফলে দড়ি টানাটানির লড়াই হবে এই কেন্দ্রে। জয়তিলক কার কপালে পরাবেন জনতা, তার জন্য ৪ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ঝাড়গ্রামে ভোট ২৫ মে, ষষ্ঠ দফায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.