Advertisement
Advertisement

Breaking News

Asansol

প্রার্থী খুঁজছে BJP, হিন্দিভাষী ‘বিহারীবাবু’ তুরুপের তাস TMC’র, আসানসোলে কতটা ভোট কাটবে বামেরা?

আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রটি বরাবরই লালদুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন নিশ্চিহ্ন সেই বামেরাই।

Lok Sabha Election 2024: In depth analysis of Asansol constituency
Published by: Paramita Paul
  • Posted:March 31, 2024 6:39 pm
  • Updated:March 31, 2024 6:39 pm  

শেখর চন্দ্র, আসানসোল: কয়লা খাদান আর ইস্পাত শিল্পকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রকৃতি রুখাশুখা। ঝাড়খণ্ড সীমানাবর্তী এই জেলার রাজনীতি নির্ভর করে একাধিক অঙ্কের উপর। হিন্দিভাষী ভোটার থেকে সংখ্যালঘু ফ্যাক্টর, মাফিয়ারাজ থেকে এলাকার উন্নয়নের বৈঠাই পার করতে পারে ভোটের বৈতরণী। বছর দশেক আগে এই লোকসভা কেন্দ্রে বাবুল সুপ্রিয়র হাত ধরে উত্থান হয়েছিল বিজেপির। কিন্তু তিনি দল ছাড়ার পর আসানসোল জয়ের চাবিকাঠি এখনও খুঁজে চলেছে বিজেপি। তারা এখনও প্রার্থীই চূড়ান্ত করতে পারেনি। অন্যদিকে হিন্দিভাষী ‘বিহারীবাবু’ তারকা শত্রুঘ্ন সিনহাকে প্রার্থী করে ফের চমক দিতে চেয়েছে তৃণমূলও। আবার হারানো ভোটব্যাঙ্ক ফিরে পেতে মরিয়া বামেরাও। সবমিলিয়ে এবার যে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের লড়াইটা যে সহজ নয়, তা বলাইবাহুল্য।

আসানসোলের অন্তর্গত বিধানসভা

Advertisement

লোকসভা কেন্দ্র হিসাবে আসানসোল আসনটি স্বীকৃতি পায় ১৯৫৭ সালে। পশ্চিম বর্ধমান জেলায় আসানসোল মহকুমা এবং দুর্গাপুর মহকুমা মিলিয়ে রয়েছে এই কেন্দ্র। ২০০৬ সালে ডিলিমিটেশন করা হলে হীরাপুর বিধানসভা ও উখড়া বিধানসভাটি লুপ্ত হয়ে যায়। পরিবর্তে তৈরি হয় আসানসোল দক্ষিণ এবং পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্র। পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর পূর্ব ও দুর্গাপুর পশ্চিম বিধানসভাটি বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। বর্তমানে এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভাগুলি হল-

  • পাণ্ডবেশ্বর
  • রানিগঞ্জ
  • জামুরিয়া
  • আসানসোল দক্ষিণ
  • আসানসোল উত্তর
  • কুলটি
  • বারাবনি

জনবিন্যাস

পশ্চিম বর্ধমান জেলায় ৯টি বিধানসভা রয়েছে। তার মোট ভোটার ২৩ লক্ষ ৩ হাজার ৪২৫ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ১১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৫৮৩ জন। মহিলা ভোটার ১১ লক্ষ ২৯ হাজার ৮০২ জন। জেলায় থার্ড জেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৪০ জন। তবে আসানসোল লোকসভার সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা রয়েছে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৮৬৫ জন। জনবিন্যাসের ভিত্তিতে এই কেন্দ্রে হিন্দু ভোটার ৪৬ শতাংশ। মুসলিম ভোটার ২৯.৭৩ শতাংশ। এসসি অর্থাৎ তফসিলি জাতি ভোটারের সংখ্যা ২৭.৪ শতাংশ। এসটি অর্থাৎ তফসিলি উপজাতি ভোটারের সংখ্যা সংখ্যা ৬.৩ শতাংশ।

[আরও পডুন: নিঃসন্তান মহিলাকে দিনরাত গঞ্জনা! শাশুড়িকে ‘খুন’ করে আত্মসমর্পণ গৃহবধূর]

ইতিহাস

আটের দশক থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রটি বরাবরই লালদুর্গ। অর্থাৎ কেন্দ্রটি বামেরাই বেশিরভাগ সময় নিজেদের দখলে রেখেছে। আসানসোল লোকসভা গঠনের পর ১৯৫৭ এবং ১৯৬২-র লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসকে হারিয়ে কেন্দ্রটি দখল করেছিল সোশ্যালিস্ট পার্টি। পরবর্তীকালে ১৯৭১ এবং ১৯৭৭-এর লোকসভায় সিপিএমের দখলে ছিল আসানসোল। ১৯৮০ এবং ১৯৮৪ লোকসভায় ফের যায় কংগ্রেসের দখলে। পরবর্তীকালে ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ টানা ২৫ বছর বাম মনোনীত সিপিএম প্রার্থীদের দখলেই ছিল এই লোকসভা কেন্দ্রটি। তবে সেই ইতিহাস বদলে যায় মোদিঝড়ে। প্রথমবার ভোটে দাঁড়িয়েই ইতিহাস বদলে দেন বিজেপির বাবুল সুপ্রিয়। খাদানের মাটিতে পদ্ম ফোটান তিনি। ২০১৯ সালে মার্জিন বাড়িয়ে ফের পদ্ম ফোটান। কিন্তু ২০২১-র পর ছন্দপতন। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন বাবুল। রাজ্যের মন্ত্রী হন। দলছাড়ার পাশাপাশি সাংসদ পদ থেকেও ইস্তফা দিয়েছিলে বাবুল। ফলে সেখানে লোকসভা উপনির্বাচন। আর তাতেই বিজেপিকে গোল দিয়ে জয়ী হন তৃণমূলের শত্রুঘ্ন সিনহা।

গত এক দশকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি

গত দু দশকের বেশি সময় ধরে বামেদের দখলে আসানসোল লোকসভা আসন। বিশেষ করে সিপিএমের তাবড় নেতা রবীন সেন, শ্রমিক নেতা হারাধন রায়, বিকাশ চৌধুরী এবং পরবর্তীকালে বংশগোপাল চৌধুরী সাংসদ হয়েছেন। তাঁদের নেতৃত্বেই লাল দুর্গ অক্ষুন্ন থেকেছে। তবে ২০১১ সালের বিধানসভার পর থেকে বামেদের ভোটব্যাঙ্কে ধস নামে। ৬০ শতাংশ ভোট কমে যায়। ২০১১ সালে বামেদের ভোট নেমে আসে ৩৬ শতাংশে। ২০১৬-তে বামেদের ভোট নেমে আসে ২৬ শতাংশে। আর ২০২১ সালে সেই লালদুর্গ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মাত্র ৬ শতাংশ ভোট নিয়ে এখন লড়াইয়ের ময়দানে বামেরা। ২০১৪ সালে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন গায়ক বাবুল সুপ্রিয়। ২০০৯ এর লোকসভা ভোটে যেখানে বিজেপির ছিল মাত্র ৫ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালে বিজেপির ভোট বেড়ে যায় ৩৬ শতাংশ। বিজেপির বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলের প্রার্থী দোলা সেনকে ভোটে হারিয়ে দেন প্রায় ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে। আর ২৫ বছর ধরে লোকসভা আসন ধরে রাখা বামেরা চলে যায় তৃতীয় স্থানে। তাদের ভোট নেমে আসে মাত্র ২২ শতাংশে। পরবর্তীকালে ২০১৯ সালে বাবুল সুপ্রিয়র প্রায় ২ লক্ষ ভোটে হারান তৃণমূলের প্রার্থী মুনমুন সেনকে। বিজেপির ভোট ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫১. ১৬ শতাংশ।

এর পরে আসে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট। ২০১৪ এবং ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের নিরিখে যদি ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রে আলাদা করে পরিসংখ্যান নেওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে ৭ টি বিধানসভা কেন্দ্রতেই এগিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সেই অনুযায়ী বিজেপির কাছে কাঙ্খিত জয় আসেনি। শুধুমাত্র আসানসোল দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে অগ্নিমিত্রা পাল এবং কুলটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ডাক্তার অজয় পোদ্দার বিজেপির হয়ে জয়লাভ করেন। বাকি পাঁচটি আসন ধরে রাখে তৃণমূল। বাবুলের শিবির বদলের পর লোকসভা উপনির্বাচনে বিজেপি আসনটি আর ধরে রাখতে পারেনি। তৃণমূলের প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা বিজেপি প্রার্থী অগ্রিমিত্রা পাল কে প্রায় ৩ লক্ষ ভোটে হারান। অর্থাৎ পরিসংখ্যানে নিরিখে প্রায় পাঁচ লাখ ভোটে পিছিয়ে পড়ে গেরুয়া শিবির। এখন ২০২৪-এ লোকসভায় আসানসোলে প্রেস্টিজ ফাইট পদ্ম শিবিরের কাছে।

শুধু লোকসভা আসনটি বিজেপির হাতছাড়া হয়নি। আসানসোল পুরনিগমের ১০৬ টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৮ টি ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ৩ জন বিজেপি কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দিয়ে দেয়। একইভাবে ২০২৩ এর পঞ্চায়েত ভোটেও বিজেপি সেরকম কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। একটি মাত্র পঞ্চায়েত সিপিএম গঠন করলেও বিজেপি কোনও পঞ্চায়েত গঠন করতে পারেনি।

[আরও পডুন: ‘বিজেপির মুখোশ খুলতে মহুয়াকে জেতান’, কৃষ্ণনগরের ইতিহাস তুলে রাজমাতাকে তোপ মমতার]

প্রার্থী পরিচয়

মার্চের ২ তারিখে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে ভোজপুরি গায়ক নায়ক পবন সিংয়ের নাম ঘোষণা করেছিল দল। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। ইতিমধ্যে শত্রুঘ্ন সিনহা আবারো তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। সিপিএমের তরফ থেকে প্রার্থী করা হয়েছে জামুড়িয়ার ২০১১ এবং ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী জাহানারা খানকে। ইতিমধ্যেই তিনি প্রচারে নেমে পড়েছেন। এদিকে একমাস কেটে গেলেও বিজেপি এখনো পর্যন্ত তাদের নতুন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে পারেনি। বাজারে চলছে নানা জল্পনা। কে হবেন বিজেপি প্রার্থী, তা নিয়ে এখনও জল্পনা চলছে।

নেতার শিবির বদল

একসম. তৃণমূল থাকাকালীন আসানসোলের মেয়র ছিলেন জিতেন্দ্র তেওয়ারি। তিনি পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়কও ছিলেন। এমনকী তিনি তৃণমূল জেলা সভাপতিও ছিলেন। কিন্তু ২০২১ বিধানসভা ভোটের আগে তিনি দল পরিবর্তন করে বিজেপিতে যোগ দেন। বিধানসভাতে পদ্মের টিকিটে লড়াই করেছিলেন। তবে জয় মেলেনি। এবার লোকসভা ভোটে পবন সিং প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলে এই কেন্দ্রের পদ্মপ্রার্থী হিসেবে জিতেন্দ্রর নাম উঠে আসছে।

হালফিলের হকিকত

বিজেপির প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে। একদিকে অগ্রিমিত্রা পাল অন্যদিকে রাজ্য কমিটির সদস্য কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় ও আদি বিজেপির একাংশ জিতেন্দ্রর বিরুদ্ধে জানিয়েছেন আপত্তি। ইতিমধ্যেই বিজেপি রাজ্য কমিটির সদস্য কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়কে বসিরহাটের কনভেনারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি এখন আসানসোলে থাকছেন না। থাকছেন বসিরহাটে। অন্যদিকে অগ্নিমিত্রা পালকে প্রার্থী করা হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। তিনিও এখন আসানসোলে নেই। অন্যদিকে একাই জিতেন্দ্র তেওয়ারি প্রায় একমাস ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন জনসংযোগ। কখনও মন্দির, কখনো মেলা, উৎসবে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রার্থী ঘোষণা না হলেও তিনি বিজেপির হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন আর সেই নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা।

সম্ভাবনা

বিজেপির কাছে প্রেস্টিজ ফাইট এই আসানসোল কেন্দ্রটি। কারণ বাবুল সুপ্রিয় ছেড়ে আসার পর বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। বাবুল দাবি করেছিলেন, তাঁর ব্যক্তি ক্যারিশমায় এই আসনটি বিজেপির দখলে ছিল। আসানসোল পুনরুদ্ধার করা এখন বিজেপির কাছে একমাত্র লক্ষ্য। তারা এখনও প্রার্থীই দিতে পারেনি। যদিও রাজনৈতিক মহলের দাবি, প্রার্থী যে-ই হোক না কেন, এটা মোদির ভোট। তাই অ্যাডভান্টেজ বিজেপির। অন্যদিকে নিজেদেক ভোটব্যাঙ্ক পুনরুদ্ধারে নেমেছে বামেরা। সংখ্যালঘু মুখকে প্রার্থী করেছে। আর সিপিএম তারা যদি হারানো ভোটার ফেরাতে পারে তবে ভোট কমতে পারে তৃণমূলের। তবে ফ্যাক্টর হবে হিন্দিভাষী ভোটার। এখনও পর্যন্ত লোকসভা ভোটে ঘাসফুল ফোটেনি আসানসোলে। উপনির্বাচনে জয় সহজ হলেও লোকসভায় জেতা বেশ কঠিন। ফলে এই নির্বাচনে জিততে মরিয়া ঘাসফুল শিবিরও। ভোট কাটাকাটির অঙ্কের কথা মাথায় রেখে হিন্দিভাষী ‘বিহারীবাবু’কে প্রার্থী করেছে। কিন্তু বিহারীবাবুর গায়ে লেগেছে বহিরাগত তকমা। এমতবস্থায় বিজেপি হিন্দিভাষী ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করলে চাপ বাড়বে তৃণমূলের উপর। সবমিলিয়ে আসানসোলে এবার লড়াই হাড্ডাহাড্ডি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement