সুমন করাতি, হুগলি: আরামবাগ তৃণমূলের কাছে সেই সব আসনের মধ্যে একটি, যেখানে গত লোকসভা ভোটে জেতার পরেও আরামে নেই শাসকদল। অনেকে এর সঙ্গে তুলনা করতে পারেন কাঁথি বা তমলুকের। কিন্তু সে তুলনা খানিক অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, পূর্ব মেদিনীপুরের ওই দুই কেন্দ্রের মতো আরামবাগে দলবদলের গল্প নেই। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পরিবারের সঙ্গে যোগও নেই হুগলি জেলার এই আসনের। সেই হিসাবে আরামবাগ ‘ব্যাতিক্রমী’। কারণ, গত লোকসভা নির্বাচনে দু’টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে থাকা বিজেপি ২০২১ সালের নীলবাড়ির লড়াইয়ে চারটি আসনে জিতেছিল।
ঘাসফুল বনাম পদ্মের এই লড়াই-ভূমি কিন্তু এককালে লালে-লাল ছিল। ২০০৯ সাল পর্যন্ত একবার ফরওয়ার্ড ব্লক আর একবার জনতা পার্টি ছাড়া বরাবর সিপিএম জয় পেয়েছে এই আসনে। বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন ১৯৭৭ সালে আরামবাগ থেকেই জনতা পার্টির সাংসদ হয়েছিলেন। কতটা লাল ছিল আরামবাগ? অনিল বসু একাই সাতবার জিতেছেন। সর্বোচ্চ ব্যবধান ২০০৪ সালে। প্রায় ছলাখ ভোট। সেই আরামবাগ আসন ২০০৯ সালে তফসিলি সংরক্ষিত হয়। ফলে অনিল আর দাঁড়াতে পারেননি। সিপিএম প্রার্থী করেছিল শক্তিমোহন মালিককে। ২০০৯ সালে দুলক্ষের বেশি ভোটে জয়ের ‘শক্তি’ দেখাতে পারলেও ২০১৪ সালে মুখ থুবড়ে পড়েন তিনি। তৃণমূলের অপরূপা পোদ্দারের কাছে হারেন প্রায় পৌনে চার লক্ষ ভোটে। ততদিনে সিপিএম-ও অনিলকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিল।
অপরূপার প্রথম জয়ের সময়ে আরামবাগে বিজেপির ভোট ছিল মাত্র ১১.৬৩ শতাংশ। কিন্তু ২০১৯ সালে তা পৌঁছে যায় ৪৪.০৬ শতাংশে। সিপিএমের ভোট কমে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশের মতো। অপরূপা দ্বিতীয়বার জিতলেও দলের ভোট ১১ শতাংশের কাছাকাছি কমে। জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ১ হাজার ১৪২ ভোট। ২০১৯ সালের ২৩ মে ভোট গণনার দিন অনেকটা সময় বিজেপিই এগিয়ে ছিল। তার পরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শুরু হয়। অনেক ওঠানামার শেষে হাসি ফোটে ঘাসফুল শিবিরের।
বেশ কিছুদিন ধরেই অল্পের জন্য জয় পাওয়া অপরূপার নম্বর কমে গিয়েছেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও খুব ‘পছন্দে’র নন তিনি। এই পরিস্থিতিতে কে আরামবাগের টিকিট পাবেন, তা নিয়ে তৃণমূলে জল্পনা ছিল। জেলা পরিষদের সদস্য মিতালি বাগকে যে তৃণমূল প্রার্থী করতে পারে, তা দলের শীর্ষনেতাদের অনেকেই ভাবতে পারেননি। পেশায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মিতালি গোঘাট-২ ব্লক মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী। পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যের দায়িত্বও সামলেছেন এক সময়ে। তবে রাজ্য তো দূরের কথা, জেলা তৃণমূলেও তিনি প্রার্থী হওয়ার আগে ‘অপরিচিত’ ছিলেন। তবে ‘সৎ এবং প্রতিবাদী’ হিসাবে মিতালির পরিচিতি রয়েছে গোঘাটে। ‘কঠিন’ আসনে প্রার্থী হওয়ার পিছনে অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে তাঁর ‘সহজ’ জীবন। বছর আটচল্লিশের অবিবাহিতা মিতালি এখনও থাকেন মাটির বাড়িতে। তবে সেটি দোতলা। রাজনীতি করেছেন একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে।
আরামবাগের ভোট নিয়ে সব চেয়ে আনন্দ গোঘাটের বাসিন্দাদের। মিতালির মতোই বিজেপির প্রার্থী অরূপকান্তি দিগাড়ের বাড়িও গোঘাট বিধানসভা এলাকায়। হাজিপুর পঞ্চায়েতের দাতপুরে থাকেন ‘ভূমিকন্যা’ মিতালি। আর কামারপুকুর পঞ্চায়েতের দ্বারিয়াপুরের বাসিন্দা ‘ভূমিপুত্র’অরূপকান্তি। গত বিধানসভা ভোটের অঙ্ক দেখলে স্কুলশিক্ষক অরূপকান্তিই এগিয়ে। তবে তৃণমূল এগিয়ে রাখছে মিতালিকেই। আর গোঘাট ভাবছে, যিনিই জিতুন, সাংসদ থাকবেন তাদেরই। সিপিএমের বিপ্লবকুমার মৈত্রের বাড়ি অবশ্য গোঘাটে নয়। তবে আরামবাগ মহকুমারই খানাকুলের পূর্ব রাধানগরে। যেখানে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি। বিপ্লবের বাবা বংশীবদন মৈত্র খানাকুলের বিধায়ক ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা বিপ্লব ২০১০ সালে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের চাকরি পান। বরাবরের বামপন্থী পরিবারের ছেলে বাবার পথ ধরেই এসেছেন বাম রাজনীতিতে।
বিপ্লব ভোট কাটলে কার উপকার হবে, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। কিন্তু বিজেপি জয় নিয়ে নিশ্চিন্ত। ২০২১ সালে হুগলি জেলার বাকি এলাকায় খারাপ ফলের মধ্যেও এই আসনের আরামবাগ, খানাকুল, পুরশুড়া এবং গোঘাট জিতেছিল বিজেপি। বাকি তিনটি হরিপাল, তারকেশ্বর এবং চন্দ্রকোনায় জয় পেয়েছিল তৃণমূল। সব মিলিয়ে লোকসভার হিসাবে বিজেপি হাজার ষাটেক ভোটে এগিয়ে। তবে বিজেপি নেতৃত্ব এই আসনকেও সহজে নিচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী মোদিও জোড়া সভা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘আরাম’ মানে ‘হারাম’। জয় চাইলে খাটতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.